বিশ্ব

রাশিয়ায় ডালিম রপ্তানি শুরু করেছে আফগানিস্তান

Advertisement

আফগানিস্তান থেকে প্রথমবারের মতো রাশিয়ায় ডালিম রপ্তানির মাধ্যমে দেশটি তাদের অর্থনৈতিক ইতিহাসে নতুন একটি অধ্যায়ের সূচনা করেছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত ও দীর্ঘদিন ধরে নিষেধাজ্ঞা-বেষ্টিত এই দেশটি এখন ধীরে ধীরে বিশ্ববাণিজ্যে নিজেদের অবস্থান পুনর্গঠন করছে।

আফগান সরকারের মুখপাত্র মাওলানা জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ এক বিবৃতিতে জানান, আফগানিস্তানের কান্দাহার প্রদেশ থেকে প্রথম ধাপে ২৫ টন ডালিম রাশিয়ায় পাঠানো হয়েছে। তিনি বলেন, “এই রপ্তানি আমাদের কৃষি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি বড় সাফল্য। আফগান ফলবিশেষ করে ডালিম এখন আন্তর্জাতিক বাজারে স্থান করে নিচ্ছে, যা আমাদের জন্য গর্বের বিষয়।”

আফগানিস্তানের ডালিম: বিশ্বে সুনাম অর্জনের পথে

ডালিম আফগানিস্তানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ফল। কান্দাহার, হেলমান্দ, ফারাহ ও কুন্দুজ প্রদেশে ব্যাপকভাবে ডালিম চাষ করা হয়। উর্বর মাটি ও অনুকূল আবহাওয়ার কারণে এখানকার ডালিম রঙে, স্বাদে ও গুণমানে অসাধারণ। আফগান ডালিমের বীজ বড়, রসালো এবং প্রাকৃতিকভাবে মিষ্টি — যা আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যাপক চাহিদা তৈরি করেছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, আফগান ডালিমের মান ভারত, তুরস্ক বা ইরানের ডালিমের সমান, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে আরও উন্নত। পূর্বে এই ডালিমের মূল রপ্তানি বাজার ছিল পাকিস্তান, ভারত ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। এখন রাশিয়ার বাজারে প্রবেশের মাধ্যমে আফগানিস্তান একটি নতুন সম্ভাবনাময় দিগন্তে প্রবেশ করেছে।

প্রথম চালান ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

মাওলানা মুজাহিদ জানান, আফগানিস্তান থেকে রাশিয়ায় পাঠানো প্রথম চালানে ২৫ টন ডালিম ছিল। এটি কান্দাহার প্রদেশের নির্বাচিত কৃষকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই ডালিমগুলো ঠান্ডা পরিবহন ব্যবস্থার মাধ্যমে সীমান্ত পেরিয়ে মধ্য এশিয়ার রুটে রাশিয়ায় পৌঁছায়।

সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ রপ্তানির পরিমাণ ২৫০ টনে উন্নীত করা হবে। তিনি আরও জানান, আগামী বছর থেকে আফগান রপ্তানি খাতে ডালিমের পাশাপাশি আঙুর, বাদাম, ডুমুর ও শুকনো ফলের রপ্তানিও শুরু করার পরিকল্পনা রয়েছে।

রাশিয়ার সঙ্গে নতুন বাণিজ্যিক সম্পর্ক

রাশিয়া বর্তমানে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে কৃষিপণ্য আমদানিতে আগ্রহী। ইউক্রেন যুদ্ধের পর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়া বিকল্প বাজার খুঁজছে — সেই সুযোগেই আফগানিস্তান নতুন রপ্তানি অংশীদার হিসেবে এগিয়ে এসেছে।

রাশিয়ার কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আফগানিস্তান থেকে কৃষিপণ্য আমদানি রাশিয়ার বাজারে নতুন বৈচিত্র্য আনবে। বিশেষ করে প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত, রাসায়নিক-মুক্ত ফলের প্রতি রাশিয়ান জনগণের আগ্রহ বাড়ছে। আফগান ডালিম সেই চাহিদা পূরণে একটি বড় ভূমিকা রাখতে পারে।

আফগান কৃষকদের নতুন আশার আলো

আফগান কৃষকদের জীবিকা মূলত কৃষি নির্ভর। দীর্ঘ যুদ্ধ ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে বহু কৃষক অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। নতুন রপ্তানি বাজার তাদের জন্য এক নতুন আশার আলো এনে দিয়েছে।

কান্দাহারের এক কৃষক, আব্দুল হামিদ খান, স্থানীয় সংবাদমাধ্যমকে বলেন, “আমরা বহু বছর ধরে ডালিম চাষ করছি, কিন্তু বিদেশে রপ্তানি করতে পারিনি। এবার রাশিয়ার বাজারে রপ্তানি শুরু হওয়ায় আমরা ন্যায্য দাম পাওয়ার আশা করছি।”

রপ্তানির এই উদ্যোগে স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে বেসরকারি ব্যবসায়ী ও সরকারের যৌথ সহযোগিতা রয়েছে। কৃষকদের উৎপাদিত ফল সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও রপ্তানির উপযোগী করতে আধুনিক সুবিধা গড়ে তোলা হচ্ছে।

অর্থনৈতিক তাৎপর্য ও সম্ভাবনা

বিশেষজ্ঞদের মতে, আফগানিস্তানের অর্থনীতি বহু বছর ধরে বিদেশি সহায়তার ওপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু এখন দেশটি কৃষি পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে স্বনির্ভরতার পথে হাঁটছে। কৃষিপণ্য রপ্তানির এই উদ্যোগ শুধু দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করবে না, বরং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যেও আফগানিস্তানের অবস্থানকে মজবুত করবে।

অর্থনীতিবিদ ড. সায়েদ আজমতুল্লাহ বলেন, “আফগানিস্তানের কৃষি পণ্য যেমন ডালিম, আঙুর, বাদাম এবং শুকনো ফল বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতামূলক হতে পারে। যদি সরকার ও বেসরকারি খাত যৌথভাবে কাজ করে, তবে আফগানিস্তান দক্ষিণ এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হতে পারে।”

চ্যালেঞ্জ এখনো রয়ে গেছে

তবে সফল রপ্তানির পথে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। আফগানিস্তানে এখনও আধুনিক পরিবহন ব্যবস্থা ও রপ্তানি অবকাঠামোর ঘাটতি রয়েছে। সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ, নিরাপত্তা পরিস্থিতি এবং আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং নিষেধাজ্ঞা এখনো আফগান ব্যবসায়ীদের জন্য বাধা সৃষ্টি করছে।

এ ছাড়া পণ্য পরিবহন খরচ এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রাখার বিষয়েও আরও সচেতনতা দরকার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার যদি কৃষকদের প্রশিক্ষণ, সংরক্ষণ প্রযুক্তি ও রপ্তানি লজিস্টিক উন্নয়নে বিনিয়োগ করে, তবে আফগান ডালিম বিশ্ববাজারে দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকবে।

আফগানিস্তানের জন্য একটি নতুন অধ্যায়

রাশিয়ায় ডালিম রপ্তানির এই উদ্যোগ কেবল অর্থনৈতিক নয়, এটি আফগানিস্তানের জন্য একটি কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবেও দেখা হচ্ছে। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা ও আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতার মধ্যেও দেশটি এখন নতুন বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, রপ্তানির মাধ্যমে আফগানিস্তান বিশ্ব সম্প্রদায়ের সঙ্গে পুনরায় সম্পর্ক স্থাপনের সুযোগ পাচ্ছে। অর্থনৈতিক সংযোগ যত বাড়বে, ততই আন্তর্জাতিক পরিসরে তাদের অবস্থান সুদৃঢ় হবে।

ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা

আফগান সরকার জানিয়েছে, ডালিম রপ্তানির এই উদ্যোগ সফল হলে ভবিষ্যতে ইউরোপ, চীন ও মধ্যপ্রাচ্যের বাজারেও প্রবেশের পরিকল্পনা রয়েছে। ইতিমধ্যেই কয়েকটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থা আফগান ফলের মান যাচাই ও দীর্ঘমেয়াদি ক্রয়চুক্তি করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, আগামী তিন বছরে কৃষিপণ্য রপ্তানি দ্বিগুণ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে শুধু কৃষকই নয়, দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি চাঙ্গা হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

রাশিয়ায় আফগান ডালিম রপ্তানি শুরু হওয়া নিঃসন্দেহে আফগানিস্তানের জন্য একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের মানুষের আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়া, কৃষি খাতের পুনর্জাগরণ এবং আন্তর্জাতিক বাজারে নিজেদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা — সবকিছু মিলিয়ে এটি একটি আশাব্যঞ্জক সূচনা

যদি এই ধারা অব্যাহত থাকে, তবে খুব শিগগিরই আফগানিস্তান দক্ষিণ এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ কৃষি রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে।

MAH – 13511 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button