পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার দুই দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে আজ (শনিবার) দুপুরে বাংলাদেশে পৌঁছেছেন। প্রায় ১৩ বছর পর কোনো পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফর বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি কূটনৈতিক অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এই সফরকে কেন্দ্র করে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নয়ন, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার, এবং আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদারের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে।
ঢাকায় পৌঁছে উষ্ণ অভ্যর্থনা
শনিবার দুপুরে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছান ইসহাক দার। তাকে অভ্যর্থনা জানান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব নজরুল ইসলাম। পরে তিনি রাজধানীতে অবস্থান নেন এবং বিকেলে পাকিস্তান হাইকমিশনের আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দেন।
এই সংবর্ধনায় শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, এবং পেশাজীবীরা উপস্থিত ছিলেন। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কের অতীত ইতিহাস, বর্তমান অবস্থা এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা হয়।
ব্যবসা-বাণিজ্যে নতুন চুক্তির সম্ভাবনা
আগামীকাল (রবিবার) সকালে ঢাকার একটি অভিজাত হোটেলে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে প্রাতরাশ বৈঠকে বসবেন ইসহাক দার। এই বৈঠকে দুই দেশের ব্যবসায়িক সহযোগিতা বাড়ানো, বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা দূর করা, এবং নতুন বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি নিয়ে আলোচনা হবে।
বৈঠক শেষে সকাল ১০টার দিকে তিনি পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করবেন। কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, বৈঠকে ৬-৭টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক (MoU) সই হতে পারে। এর মধ্যে থাকবে—
বাণিজ্য ও বিনিয়োগ উন্নয়ন
শিক্ষা ও গবেষণা বিনিময় কর্মসূচি
সাংস্কৃতিক বিনিময় চুক্তি
কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তায় সহযোগিতা
স্বাস্থ্য ও ওষুধ খাতে সমঝোতা
এছাড়া উভয় দেশ আঞ্চলিক শান্তি, নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা নিয়ে মতবিনিময় করবে।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক
রবিবার বিকেল ৪টার দিকে ইসহাক দার সাক্ষাৎ করবেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে। সেখানে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতি, আঞ্চলিক সহযোগিতা, জলবায়ু পরিবর্তন, এবং দারিদ্র্য বিমোচন প্রসঙ্গে আলোচনা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
রাজনৈতিক সাক্ষাৎকার: বিএনপি ও জামায়াত নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের গুঞ্জন
কূটনৈতিক মহলে আলোচনা রয়েছে যে, ইসহাক দার বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও সাক্ষাৎ করবেন। বিশেষ করে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার গুলশানের বাসায় তার সঙ্গে বৈঠকের সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া জামায়াতে ইসলামীর কিছু নেতার সঙ্গেও বৈঠক হতে পারে। এই সাক্ষাৎগুলোতে পাকিস্তানের ভূমিকাকে ঘিরে রাজনৈতিক আলাপ হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সফরের পেছনের প্রেক্ষাপট
এই সফরটি আসলে হওয়ার কথা ছিল ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে। তখন পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব আমেনা বেলুচ ঢাকা সফর করেছিলেন। এরপর ইসহাক দারের সফর চূড়ান্ত হয়। কিন্তু ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত উত্তেজনার কারণে সফর পিছিয়ে যায়। অবশেষে আগস্টে এই সফর অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “এই সফর পাকিস্তান-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।”
১৩ বছর পর পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফর
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, দীর্ঘ ১৩ বছর পর কোনো পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকা সফর করছেন। সর্বশেষ ২০১২ সালে হিনা রব্বানি খার বাংলাদেশ সফর করেছিলেন। এরপর থেকে রাজনৈতিক টানাপোড়েন, ঐতিহাসিক ইস্যু এবং আঞ্চলিক উত্তেজনার কারণে সম্পর্ক কিছুটা স্থবির ছিল।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দক্ষিণ এশিয়ায় ভূরাজনৈতিক পরিবর্তন, বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI), সাপ্লাই চেইনের পুনর্গঠন, এবং আঞ্চলিক অর্থনৈতিক জোটের উত্থান—এসব কারণে বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক নতুন করে আলোচনায় এসেছে।
দুই দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কের বর্তমান অবস্থা
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম। বর্তমানে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে রপ্তানি করা হয় প্রধানত কাপড়ের কাঁচামাল, তুলা, পলিমার, ওষুধ, এবং ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্য। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে যায় পোশাক, জুট পণ্য, চামড়া এবং কিছু কৃষিজাত পণ্য।
তবে বাণিজ্যে নানা শুল্ক প্রতিবন্ধকতা থাকায় দুই দেশের ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরে প্রিফারেনশিয়াল ট্রেড এগ্রিমেন্ট (PTA) বা ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট (FTA) চেয়ে আসছেন। এই সফরে সেই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা আসতে পারে বলে জানা গেছে।
দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের জটিল ইতিহাস
বাংলাদেশ-পাকিস্তানের সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে জটিল। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর দীর্ঘ সময় দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন ছিল। পরবর্তীতে সম্পর্ক স্বাভাবিক হলেও বিভিন্ন সময়ে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে দুই দেশই অর্থনৈতিক সহযোগিতা, শিক্ষা-বিনিময় কর্মসূচি, এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্ক জোরদার করার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে।
কূটনৈতিক বিশ্লেষণ
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই সফর শুধু কূটনৈতিক সৌজন্য নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়ার পরিবর্তিত ভূরাজনীতির অংশ। ভারত-চীন প্রতিদ্বন্দ্বিতা, আফগানিস্তানের পরিস্থিতি, এবং সাপ্লাই চেইন ইস্যুতে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ উভয়েই নতুন মিত্র খুঁজছে।
একজন বিশেষজ্ঞের মতে—
“বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় অর্থনৈতিক কেন্দ্র হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। পাকিস্তান চায় সেই সম্ভাবনার অংশীদার হতে।”
আগামী পরিকল্পনা ও সম্ভাবনা
সফর শেষে সোমবার (২৪ আগস্ট) দুপুরে ইসহাক দার ঢাকা ত্যাগ করবেন। তবে এই সফরের প্রভাব আগামী কয়েক বছর পর্যন্ত থাকতে পারে। বিশেষত নতুন চুক্তি ও বিনিয়োগ বাস্তবায়িত হলে দুই দেশের সম্পর্ক নতুন মাত্রা পাবে।
সারসংক্ষেপে গুরুত্বপূর্ন দিকগুলো:
১৩ বছর পর পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর
৬-৭টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হওয়ার সম্ভাবনা
ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগে নতুন সুযোগ সৃষ্টি
রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক নিয়ে জোর আলোচনা
দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে সফরের গুরুত্ব
MAH – 12451 , Signalbd.com



