চট্টগ্রামের সাগরিকা এলাকায় আজ ভোরে একটি মালবাহী ট্রেনের সঙ্গে চালবোঝাই ট্রাকের ভয়াবহ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে ট্রেনের ইঞ্জিন লাইনচ্যুত হয়ে পড়ে, আর ট্রাকটি দুমড়ে-মুচড়ে যায়। দুর্ঘটনার কারণে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ঢাকা ও দেশের অন্যান্য স্থানে মালবাহী ট্রেন চলাচল সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে গেছে।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, সোমবার (২৮ অক্টোবর) ভোর ৪টার দিকে নগরীর সাগরিকা স্টেডিয়াম সংলগ্ন রেলগেট এলাকায় এই দুর্ঘটনাটি ঘটে।
কীভাবে ঘটল দুর্ঘটনাটি?
রেলওয়ের কর্মকর্তাদের প্রাথমিক তথ্যমতে, ভোরে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে একটি কনটেইনারবোঝাই ট্রেন ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেয়। ট্রেনটি সাগরিকা এলাকায় পৌঁছালে সিগন্যাল অমান্য করে একটি ট্রাক দ্রুতগতিতে রেললাইন অতিক্রমের চেষ্টা করে। মুহূর্তের মধ্যেই ট্রাকটি ট্রেনের ইঞ্জিনে সজোরে আঘাত হানে। প্রচণ্ড ধাক্কায় ট্রেনের ইঞ্জিন উল্টে যায় এবং কয়েকটি বগি লাইনচ্যুত হয়।
দুর্ঘটনার শব্দ এতটাই তীব্র ছিল যে আশপাশের এলাকাবাসী ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। তারা দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়ে উদ্ধারকাজে অংশ নেন।
উদ্ধার অভিযান চলছে
দুর্ঘটনার খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে চট্টগ্রাম রেলওয়ে পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও রেলওয়ে জরুরি উদ্ধার দল ঘটনাস্থলে পৌঁছে যায়। সকাল ৬টার দিকে উদ্ধার কাজ শুরু হয়, যা এখনও চলছে বলে জানিয়েছেন রেলওয়ে কর্মকর্তারা।
চট্টগ্রাম রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শহিদুল ইসলাম বলেন,
“ট্রাক ও মালবাহী ট্রেনের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে। তবে এই লাইনটি মূলত মালবাহী ট্রেনের জন্য ব্যবহৃত হয়, তাই যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচলে কোনো সমস্যা হয়নি। আমরা উদ্ধার কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।”
তিনি আরও জানান, দুর্ঘটনায় কেউ গুরুতর আহত হয়নি বলেই প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। তবে ট্রেনের ইঞ্জিন ও ট্রাকের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
ট্রেন চলাচলে প্রভাব
দুর্ঘটনার কারণে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। এতে বন্দর কার্যক্রমে সাময়িক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। কারণ চট্টগ্রাম বন্দর থেকে প্রতিদিন গড়ে ৮ থেকে ১০টি কনটেইনার ট্রেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাতায়াত করে, যার মাধ্যমে দেশের শিল্পকারখানায় প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ও রপ্তানি পণ্য পরিবহন হয়।
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, দুর্ঘটনাস্থল দ্রুত মেরামতের জন্য জরুরি প্রকৌশল দল কাজ শুরু করেছে। ইঞ্জিন ও বগি সরিয়ে নেওয়ার পর লাইন মেরামত সম্পন্ন হলে বিকেলের মধ্যে মালবাহী ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হতে পারে।
ট্রাকচালকের দায় ও আইনগত ব্যবস্থা
রেলওয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, দুর্ঘটনার মূল কারণ ট্রাকচালকের অসাবধানতা। প্রাথমিক তদন্তে দেখা গেছে, রেলগেটের ব্যারিয়ার নামানোর পরও ট্রাকটি দ্রুত পাড়ি দিতে যায়। এতে সংঘর্ষ এড়ানো সম্ভব হয়নি।
ওসি শহিদুল ইসলাম বলেন,
“আমরা ট্রাকচালককে আটক করেছি। তার বিরুদ্ধে রেলওয়ে আইনে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে। রেলক্রসিংয়ে সিগন্যাল অমান্য করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।”
সাগরিকা রেলগেটের ঝুঁকি ও অতীত দুর্ঘটনা
স্থানীয়রা জানান, সাগরিকা রেলগেটটি দীর্ঘদিন ধরেই ঝুঁকিপূর্ণ। প্রায়ই এখানে সিগন্যাল অমান্য করে গাড়ি চলাচল করে, আর কর্তৃপক্ষের নজরদারি খুবই সীমিত। এ গেটে আগে আরও কয়েকটি ছোট দুর্ঘটনা ঘটেছে, তবে এবারটির মাত্রা ছিল ভয়াবহ।
২০২৩ সালে একই এলাকায় একটি মিনিবাস ট্রেনের সামনে পড়ে ৫ জন আহত হয়েছিলেন। সেই ঘটনার পরও রেলগেটের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়নি বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর।
দুর্ঘটনার পর এলাকা জুড়ে আতঙ্ক
দুর্ঘটনার পর সকাল থেকেই এলাকায় ব্যাপক ভিড় জমে। অনেকেই মোবাইল ফোনে ভিডিও ধারণ করেন। দুর্ঘটনাস্থলের আশপাশে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সাগরিকা স্টেডিয়াম এলাকা থেকে আকবরশাহ পর্যন্ত তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়।
স্থানীয় ব্যবসায়ী মফিজুল হক বলেন,
“ভোরে এমন ভয়াবহ শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। বাইরে এসে দেখি, ট্রেনের ইঞ্জিন উল্টে আছে, ট্রাকটা পুরো চূর্ণ হয়ে গেছে। ভাগ্য ভালো, বড় কোনো প্রাণহানি হয়নি।”
রেল কর্তৃপক্ষের তদন্ত টিম গঠন
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় ব্যবস্থাপক (ডিআরএম) মোহাম্মদ শওকত হোসেন জানিয়েছেন, ঘটনাটি তদন্তে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
“তদন্ত টিমকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। দুর্ঘটনার সঠিক কারণ, ক্ষয়ক্ষতি এবং ভবিষ্যতে এমন ঘটনা এড়াতে কী পদক্ষেপ নেওয়া যায় তা প্রতিবেদনে উল্লেখ থাকবে।”
রেল কর্তৃপক্ষ বলছে, দুর্ঘটনায় ট্রেনের ইঞ্জিন ও লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় অন্তত ৫০ লাখ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
রেলগেট নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন
বাংলাদেশ রেলওয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে প্রায় ১,৫০০-এর বেশি লেভেল ক্রসিং রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেকই অরক্ষিত বা আংশিক নিয়ন্ত্রিত। এসব স্থানে মানবিক ত্রুটি, অসচেতনতা ও যান্ত্রিক সমস্যা থেকেই প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে।
রেলওয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন,
“যেসব রেলগেটে ম্যানুয়াল ব্যারিয়ার আছে, সেখানে আধুনিক ইলেকট্রনিক সিগন্যালিং সিস্টেম চালু করা দরকার। পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় চালকদের সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি।”
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রেল দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান
বাংলাদেশ রেলওয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী,
- ২০২৪ সালে দেশে ৩৪৬টি রেল দুর্ঘটনা ঘটেছে,
- যার মধ্যে প্রায় ৬০%-এর কারণ ছিল লেভেল ক্রসিংয়ে যানবাহনের অসতর্কতা।
- এতে ৬৫ জনের প্রাণহানি এবং শতাধিক মানুষ আহত হন।
এখনও দেশের অনেক স্থানে স্বয়ংক্রিয় গেট বা পর্যাপ্ত গেটম্যান না থাকায় এমন দুর্ঘটনা প্রায়ই ঘটছে।
বিশেষজ্ঞ মতামত
পরিবহন বিশ্লেষক ড. কামরুল ইসলাম মনে করেন,
“রেল ক্রসিংয়ে ট্রাফিক সিগন্যাল, ব্যারিয়ার ও সিসিটিভি নজরদারি জোরদার করা না হলে এ ধরনের দুর্ঘটনা বাড়তেই থাকবে। দুর্ঘটনার পর দায়ী চালককে শাস্তি দিলেও মূল সমস্যার সমাধান হয় না।”
তিনি বলেন, দেশের অর্থনীতির একটি বড় অংশ রেলপথে মালবাহী পরিবহনের উপর নির্ভর করে। তাই এ খাতে আধুনিকায়ন, নিরাপত্তা ও প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি এখন সময়ের দাবি।
চট্টগ্রামের সাগরিকা রেলগেট দুর্ঘটনা আবারও প্রমাণ করল—রেলপথের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় এখনও বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে। ট্রাকচালকের অসতর্কতা যেমন একটি কারণ, তেমনি পর্যাপ্ত সিগন্যাল ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকাও সমানভাবে দায়ী।
জনসচেতনতা বৃদ্ধি, আধুনিক সিগন্যাল ব্যবস্থা ও রেলগেট ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ভবিষ্যতে এমন দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
MAH – 13508 I Signalbd.com



