বাংলাদেশ

মেট্রোরেল পুরোদমে চালু হবে দুপুরের আগেই

Advertisement

রাজধানী ঢাকাবাসীর বহু প্রতীক্ষার অবসান ঘটতে যাচ্ছে আজ সোমবার। উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেলের পুরো রুটে আজ দুপুরের আগেই পুরোদমে ট্রেন চলাচল শুরু হতে যাচ্ছে। ঢাকা মাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) নিশ্চিত করেছে, সব ধরনের পরীক্ষামূলক কার্যক্রম সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে এবং এখন চালুর জন্য প্রস্তুত পুরো রুট।

আজ সকালেই আগারগাঁও থেকে শাহবাগ অংশে দুই দফায় পরীক্ষামূলকভাবে ট্রেন চালানো হয়েছে। উভয় ক্ষেত্রেই কোনো প্রযুক্তিগত ত্রুটি বা যান্ত্রিক সমস্যা পাওয়া যায়নি। এর ফলে দুপুরের আগে মেট্রোরেলের পূর্ণাঙ্গ যাত্রা শুরুর ব্যাপারে আশাবাদী কর্তৃপক্ষ।

ফার্মগেট দুর্ঘটনার পর দ্রুত সংস্কার, নিরাপত্তা জোরদার

গতকাল রোববার দুপুরে রাজধানীর ফার্মগেটে ঘটে যায় এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। মেট্রোরেলের পিলার থেকে একটি বিয়ারিং প্যাড খুলে নিচে পড়ে যায়, এতে এক যুবকের মৃত্যু হয়। দুর্ঘটনার পরই কর্তৃপক্ষ দ্রুত মেট্রোরেল চলাচল স্থগিত করে নিরাপত্তা পর্যালোচনায় নামে।

প্রায় আড়াই ঘণ্টা বন্ধ থাকার পর বিকেল তিনটার দিকে উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশে ট্রেন চলাচল পুনরায় শুরু হয়। আর প্রায় সাত ঘণ্টা পর সন্ধ্যা সোয়া সাতটায় মতিঝিল থেকে শাহবাগ পর্যন্ত ট্রেন চলাচল আংশিকভাবে চালু হয়।

আজ সোমবার সকাল থেকে প্রকৌশলীরা ঘটনাস্থলে নতুন বিয়ারিং প্যাড স্থাপন করে পূর্ণাঙ্গ নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন। এরপরই আবার ট্রেন চালিয়ে দেখা হয়—সব কিছু ঠিকভাবে কাজ করছে কি না। ডিএমটিসিএল সূত্র জানিয়েছে, কোনো সমস্যা না পাওয়ায় তারা আত্মবিশ্বাসী যে দুপুরের আগেই মেট্রোরেল পুরোদমে চালু হবে।

ডিএমটিসিএলের বক্তব্য: “আমরা সম্পূর্ণ প্রস্তুত”

ঢাকা মাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) মহাব্যবস্থাপক ফারুক আহমেদ বলেন,

“আমরা এখন বন্ধ থাকা অংশে পরীক্ষামূলক ট্রেন চালাচ্ছি। প্রাথমিক পরীক্ষার ফলাফল অত্যন্ত সন্তোষজনক। খুব দ্রুতই পুরো রুটে যাত্রী পরিবহন শুরু হবে।”

তিনি আরও জানান, দুর্ঘটনার পর থেকে প্রতিটি অংশ পুনরায় পরীক্ষা করা হয়েছে এবং যান্ত্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত কোনো ট্রেন চালানো হবে না।
“নিরাপত্তাই আমাদের প্রথম অগ্রাধিকার,”—যোগ করেন তিনি।

মেট্রোরেলের বর্তমান অবস্থা ও পূর্ণ রুটের বিবরণ

উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত পুরো রুটটি প্রায় ২০.১ কিলোমিটার দীর্ঘ। এতে মোট ১৬টি স্টেশন রয়েছে। উত্তরা উত্তর থেকে শুরু হয়ে ডায়াবেটিক হাসপাতাল, পল্লবী, মিরপুর, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, আগারগাঁও, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা হয়ে এটি মতিঝিলে গিয়ে শেষ হয়।

২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশ উদ্বোধন করেন। এরপর ধাপে ধাপে আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত অংশ চালুর প্রস্তুতি চলে। আজকের পূর্ণ উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে রাজধানীর এই মেগা প্রজেক্টের সবকটি অংশ একসঙ্গে সংযুক্ত হতে যাচ্ছে।

মেট্রোরেলের গুরুত্ব ও প্রত্যাশিত সুফ

মেট্রোরেল শুধু একটি পরিবহন প্রকল্প নয়—এটি ঢাকাবাসীর জীবনে নতুন অধ্যায়। রাজধানীর যানজট নিয়ন্ত্রণে আনতে এই প্রকল্প বিশেষ ভূমিকা রাখবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

একটি ট্রেনে একসঙ্গে প্রায় ১,৭০০ যাত্রী চলাচল করতে পারবেন। প্রতিটি ট্রেন ১০ মিনিটের ব্যবধানে চলবে এবং গতি ঘণ্টায় প্রায় ১০০ কিলোমিটার। ফলে উত্তরা থেকে মতিঝিল যেতে সময় লাগবে মাত্র ৩৫ মিনিট, যেখানে আগে লেগে যেত দেড় থেকে দুই ঘণ্টা পর্যন্ত।

ঢাকা মেট্রোরেল চালু হলে—

  • যানজট ব্যাপকভাবে কমবে
  • কর্মজীবী মানুষ সময় বাঁচাতে পারবেন
  • পরিবেশ দূষণ কমবে
  • নগর জীবনে আধুনিকতার ছোঁয়া আসবে
  • অর্থনৈতিক কার্যক্রমে গতি আসবে

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেট্রোরেল ঢাকার আর্থসামাজিক জীবন বদলে দেবে।

নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বাড়তি নজর

ফার্মগেট দুর্ঘটনার পর ডিএমটিসিএল নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বাড়তি পদক্ষেপ নিয়েছে। প্রতিটি স্টেশনে সিসিটিভি ক্যামেরা, রেললাইন পর্যবেক্ষণ যন্ত্র এবং জরুরি যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন করা হয়েছে।

এছাড়া নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিশেষ টেকনিক্যাল টিম ২৪ ঘণ্টা কাজ করবে। বিয়ারিং প্যাড, রেল ট্র্যাক, বৈদ্যুতিক সংযোগ—সবকিছুই এখন নতুন করে পর্যালোচনায় আনা হয়েছে।

যাত্রীদের সুবিধা ও নতুন সেবা

মেট্রোরেলের যাত্রীরা এখন আরও উন্নত টিকেটিং ব্যবস্থা পাবেন। এমআরটি পাস বা স্মার্টকার্ডের পাশাপাশি মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমেও টিকিট কেনা যাবে। প্রতিটি স্টেশনে থাকবে এলিভেটর, এস্কেলেটর, ওয়াইফাই জোন ও আধুনিক অপেক্ষাকক্ষ।

ডিএমটিসিএলের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৫ লাখ যাত্রী এই রুটে চলাচল করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। এভাবে শুধু সময়ই নয়, জ্বালানি খরচও কমে আসবে, যা দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

জনগণের প্রতিক্রিয়া: আনন্দ ও আশার বন্যা

আজ সকালে উত্তরা, আগারগাঁও ও মতিঝিল স্টেশনে গিয়ে দেখা গেছে, শত শত মানুষ মেট্রোরেলে চড়ার অপেক্ষায়। অনেকেই মোবাইল ফোনে সেলফি তুলছেন, ভিডিও করছেন।

রাজধানীর অফিসগামী নাজমুল হাসান বলেন,

“আগে অফিস যেতে দুই ঘণ্টা লাগত, এখন অর্ধ ঘণ্টায় পৌঁছে যাব—এটা সত্যিই অবিশ্বাস্য।”

অন্যদিকে গৃহিণী রুবিনা পারভীন বলেন,

“ঢাকায় এমন উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা হবে ভাবতেই পারিনি। এটা আমাদের জীবনে বড় পরিবর্তন আনবে।”

সরকারি পরিকল্পনা ও ভবিষ্যৎ সম্প্রসারণ

মেট্রোরেল প্রকল্পের সফল বাস্তবায়নের পর সরকার ইতিমধ্যে আরও পাঁচটি নতুন মেট্রোরেল রুটের পরিকল্পনা নিয়েছে—

  • এমআরটি লাইন-১: বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর
  • এমআরটি লাইন-৫: হেমায়েতপুর থেকে ভাটারা
  • এমআরটি লাইন-৬ (বর্তমান): উত্তরা থেকে মতিঝিল
  • এমআরটি লাইন-২ ও লাইন-৪ ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায়

সরকারের লক্ষ্য, ২০৩০ সালের মধ্যে পুরো ঢাকাকে মেট্রোরেল নেটওয়ার্কের আওতায় আনা, যাতে রাজধানীতে আর কোনো যানজট না থাকে।

আজকের দিনটি ঢাকাবাসীর জন্য এক ঐতিহাসিক দিন। উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেলের পূর্ণ চালুর মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রবেশ করছে আধুনিক নগর পরিবহনের যুগে। কিছুদিন আগেও যেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকতে হতো, এখন সেখানে মিনিটের মধ্যে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পৌঁছানো যাবে।

সরকার, প্রকৌশলী, কর্মী—সবার প্রচেষ্টায় মেট্রোরেল আজ বাস্তব। এটি শুধু একটি রেল নয়, এটি উন্নত বাংলাদেশ গড়ার প্রতীক।

MAH – 13497 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button