বাংলাদেশের বিচার বিভাগের প্রাক্তন উজ্জ্বল মুখ, সাবেক প্রধান বিচারপতি (Chief Justice) এ বি এম খায়রুল হককে আজ সকাল ১০ টার দিকে রাজধানীর ধানমন্ডির একটি বাসা থেকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। এই গ্রেফতার ঘটনাটি দেশের বিচার ব্যবস্থার স্বচ্ছতা এবং ন্যায়বিচারের প্রশ্ন উত্থাপন করেছে।
গ্রেফতারের পেছনের কারণ: মামলা ও অভিযোগ
খায়রুল হকের বিরুদ্ধে মোট তিনটি মামলা রয়েছে, যেগুলো ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন থানায় দায়ের করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে যে মূল অভিযোগ গুলো রয়েছে তা হল:
- দুর্নীতি
- রায় জালিয়াতি
- অসংবিধানিক রায় দেওয়া
২০২৪ সালের ২৮ আগস্ট শাহবাগ থানায় দুর্নীতি এবং রায় জালিয়াতির অভিযোগে মামলা করা হয়। এই মামলাটি করেন সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী, মুজাহিদুল ইসলাম শাহীন।
আরেকটি মামলা ২০২৪ সালের ২৫ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানায় করা হয়। মামলাটি করা হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থা অসাংবিধানিক ঘোষণা করে রায় দেওয়ার জন্য। এই মামলাটি করেন নারায়ণগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এবং ফতুল্লা থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল বারী ভূঁইয়া।
এই মামলাগুলো নিয়ে দেশের আইন-আদালত মহলে এবং রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে।
সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের জীবনী ও কর্মজীবন
খায়রুল হক ছিলেন বাংলাদেশের ১৯তম প্রধান বিচারপতি। ২০১০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর তিনি প্রধান বিচারপতির পদে নিয়োগ পান। এই সময়টিতে দেশের বিচার বিভাগের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত তার নেতৃত্বে গৃহীত হয়। তবে ২০১১ সালের ১৭ মে তিনি অবসর নেন।
তার বিচারক জীবনে নানা বিতর্ক ও বিতর্কিত রায়ের জন্য তিনি অনেক সময় সমালোচিত হন। বিশেষ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তিনি যে অসাংবিধানিক রায় দিয়েছিলেন, তা নিয়ে এখনও নানা রাজনৈতিক ও আইনি বিতর্ক রয়েছে।
জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের প্রতিবাদ
সাবেক প্রধান বিচারপতির গ্রেফতারের ঘটনায় জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম একটি সংবাদ সম্মেলন করেছে। তারা সাবেক প্রধান বিচারপতিকে দেশের বিচার বিভাগ ও গণতন্ত্র ধ্বংসের মূল কারিগর হিসেবে উল্লেখ করে তৎক্ষণাৎ বিচার দাবি করেছে। তাদের মতে, দেশের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় এই ধরনের পদক্ষেপ অপরিহার্য।
ফোরামের মুখপাত্র বলেন, “দেশের বিচার ব্যবস্থা যদি স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ হয়, তাহলে উচ্চপদস্থ বিচারকও দায়মুক্ত নয়। জনগণ বিচার চায়।”
বিচার বিভাগের বর্তমান পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ
বর্তমানে বাংলাদেশের বিচার বিভাগ নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। অনেকেই মনে করেন, বিচার বিভাগের কিছু অংশ রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত নয়, যার ফলে সাধারণ মানুষের বিচার পাওয়ার অধিকার ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।
সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের গ্রেফতারের ঘটনা এ বিষয়ে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধরনের ঘটনাগুলো বিচার বিভাগের স্বচ্ছতা ও দুর্নীতি নির্মূলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে। আবার অনেকে এটিকে বিচার ব্যবস্থায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বলেও আখ্যায়িত করেছেন।
অন্যান্য প্রসঙ্গ: বিচারক ও দুর্নীতি
বাংলাদেশে বিচারক বা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অনেক পুরনো। এই ধরনের অভিযোগ মোকাবিলায় সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েছে, তবে বিচার বিভাগের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে এখনও অনেক পথ যেতে হবে বলে আইনবিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
বিচার বিভাগের স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করতে পারলেই দেশের গণতন্ত্র ও আইনের শাসন সুদৃঢ় হবে।
আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিত
আন্তর্জাতিক আদালত এবং বিচার বিভাগের উন্নত দেশগুলোতে বিচারকদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অবৈধ কার্যক্রমের অভিযোগ পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ রকম পদক্ষেপ দেশের বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থা বৃদ্ধি করতে সহায়ক হবে।
বিচার বিভাগের পরিবর্তন ও নতুন অধ্যায়ের সূচনা
সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের গ্রেফতারের ঘটনা বিচার বিভাগের জন্য এক দৃষ্টান্তস্বরূপ পরিস্থিতি। এটি প্রমাণ করে, দেশের বিচার ব্যবস্থা কতটুকু স্বচ্ছ এবং দায়িত্বশীল হতে পারে। দেশের জনগণ আশা করে, এ ধরনের পদক্ষেপ ভবিষ্যতে বিচার বিভাগকে আরও সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করে গড়ে তুলবে।
বিচার বিভাগের ওপর রাজনৈতিক ও আর্থিক চাপ থেকে মুক্তির জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন জরুরি। শুধুমাত্র তখনই দেশের নাগরিকরা বিচার বিভাগের প্রতি পূর্ণ আস্থা রাখতে পারবে।



