বিশ্ব

গাজা যুদ্ধবিরতি সমন্বয় কেন্দ্রের প্রধান নিয়োগ দিলো যুক্তরাষ্ট্র

Advertisement

গাজায় টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্রের নতুন উদ্যোগ

মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলমান গাজা সংকট ও ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাতের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র এবার এক নতুন পদক্ষেপ নিয়েছে।
ইয়েমেনে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত স্টিভেন ফ্যাগিনকে গাজা যুদ্ধবিরতি সমন্বয় কেন্দ্রের বেসামরিক প্রধান হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে ওয়াশিংটন।
এই কেন্দ্রের লক্ষ্য— প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় গৃহীত গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তি কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন ও টেকসই করা।

এই নিয়োগের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র শুধু গাজার স্থিতিশীলতা নয়, বরং পুরো মধ্যপ্রাচ্যে একটি নতুন শান্তি কাঠামো গড়ে তুলতে চায় বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ঘোষণা

তুরস্কভিত্তিক গণমাধ্যম আনাদোলু এজেন্সি জানায়, শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর এক বিবৃতিতে স্টিভেন ফ্যাগিনের নিয়োগের বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে।
বিবৃতিতে বলা হয়—

“২০২২ সাল থেকে ইয়েমেনে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করা অভিজ্ঞ কূটনীতিক স্টিভেন ফ্যাগিন এখন গাজা যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়ন পর্যবেক্ষণে মার্কিন ও মিত্র সামরিক প্রচেষ্টার নেতৃত্ব দেবেন।”

এই কেন্দ্রটি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ২০ দফা গাজা শান্তি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অন্যতম মূল প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করবে।

কিরিয়াত গাটে নতুন কেন্দ্রের কার্যক্রম

ইসরাইলের রাজধানী তেল আবিব থেকে প্রায় ৫৬ কিলোমিটার দক্ষিণে কিরিয়াত গাটে গাজা যুদ্ধবিরতি সমন্বয় কেন্দ্রটি স্থাপন করা হয়েছে।
এটি বর্তমানে একটি বহুজাতিক সমন্বয় অফিসে পরিণত হয়েছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র, মিসর, কাতার, তুরস্ক ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিরাও যুক্ত রয়েছেন।

শুক্রবার কেন্দ্রটি পরিদর্শন করে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেন,

“এই কেন্দ্রটি গাজায় যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়নে আমাদের আশা ও আস্থা বাড়িয়ে তুলেছে। আমরা বিশ্বাস করি, এই উদ্যোগ ফিলিস্তিনে স্থায়ী শান্তির পথে এক নতুন অধ্যায় রচনা করবে।”

উচ্চ পর্যায়ের মার্কিন সফর

সম্প্রতি কেন্দ্রটি পরিদর্শন করেছেন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স, মধ্যপ্রাচ্যের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ, সাবেক হোয়াইট হাউস উপদেষ্টা জ্যারেড কুশনারসহ আরও অনেকে।
তাদের উপস্থিতি ওয়াশিংটনের **“দৃঢ় প্রতিশ্রুতি”**কে পুনর্ব্যক্ত করে, যা ট্রাম্প প্রশাসনের শান্তি উদ্যোগকে আন্তর্জাতিকভাবে আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছে।

ট্রাম্পের ২০ দফা যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনা

২০২৫ সালের ১০ অক্টোবর বাস্তবায়িত হয় ট্রাম্পের ২০ দফা যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনার প্রথম ধাপ
এই ধাপে ফিলিস্তিনি বন্দিদের বিনিময়ে ইসরাইলি জিম্মিদের মুক্তি দেওয়া হয়।

পরবর্তী ধাপে রয়েছে—

  • গাজার অবকাঠামো পুনর্গঠন,
  • আন্তর্জাতিক সাহায্য তহবিল গঠন,
  • হামাসবিহীন নতুন প্রশাসন প্রতিষ্ঠা,
  • এবং নাগরিক নিরাপত্তা বাহিনী গঠন

পরিকল্পনার লক্ষ্য হলো গাজাকে ধ্বংসস্তূপ থেকে পুনরুদ্ধার করে একটি স্বনির্ভর, নিরাপদ ও প্রশাসনিকভাবে কার্যকর অঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলা।

যুদ্ধের ভয়াবহতা: নিহত ৬৮ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি

২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরাইলি আগ্রাসনে গাজায় ৬৮,০০০-এরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, গাজা বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ও বিপর্যস্ত অঞ্চলগুলোর একটি।
হাজারো পরিবার গৃহহীন, হাসপাতাল ও স্কুল ধ্বংসস্তূপে পরিণত, এবং প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ বিশুদ্ধ পানির অভাবে ভুগছে।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো গাজার পরিস্থিতিকে “মানবিক বিপর্যয়” হিসেবে ঘোষণা করেছে।
বহু বিশেষজ্ঞের মতে, এই অবস্থায় যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়ন ও শান্তি প্রতিষ্ঠা সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

ফ্যাগিনের অভিজ্ঞতা ও ভূমিকা

স্টিভেন ফ্যাগিন একজন অভিজ্ঞ মার্কিন কূটনীতিক। তিনি ইয়েমেনে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করেছেন, যেখানে গৃহযুদ্ধ, মানবিক সংকট ও আন্তর্জাতিক আলোচনার জটিলতা মোকাবিলা করতে হয়েছে তাঁকে।
গাজা কেন্দ্রের প্রধান হিসেবে তাঁর দায়িত্ব হবে—

  • যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণ,
  • ইসরাইল ও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা,
  • মানবিক সাহায্য কার্যক্রমে সমন্বয়,
  • এবং পুনর্গঠন প্রকল্পের অগ্রগতি তদারকি করা।

মার্কিন কর্মকর্তারা মনে করছেন, তাঁর অভিজ্ঞতা গাজার পুনর্গঠন প্রচেষ্টাকে ত্বরান্বিত করবে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপে মিশর, তুরস্ক ও কাতার সতর্ক আশাবাদ প্রকাশ করেছে।
তবে ইরান ও কিছু আরব দেশ এটিকে “রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের নতুন কৌশল” হিসেবে দেখছে।
অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলেছে,

“যদি এই কেন্দ্র মানবিক সাহায্য বিতরণে স্বচ্ছতা ও সমন্বয় বজায় রাখতে পারে, তবে এটি গাজা পুনর্গঠনের নতুন অধ্যায় শুরু করবে।”

গাজা পুনর্গঠনের পরিকল্পনা: ‘নতুন গাজা সিটি’ প্রকল্প

ট্রাম্প প্রশাসনের সহায়তায় গাজায় চালু হয়েছে ‘নিউ গাজা সিটি’ নামের পুনর্গঠন প্রকল্প।
এর আওতায় ধ্বংসপ্রাপ্ত এলাকায় নতুন আবাসন, হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ও ব্যবসায়িক কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইউরোপীয় বিনিয়োগকারীরা এতে অর্থায়ন করছে।

বিশ্লেষকদের মতে, এই প্রকল্প সফল হলে গাজা শুধু পুনরুদ্ধারই নয়, মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম আধুনিক শহরে পরিণত হতে পারে।

চ্যালেঞ্জ ও সমালোচনা

তবে এই উদ্যোগকে ঘিরে বিতর্কও রয়েছে।
ফিলিস্তিনি নাগরিক সমাজের অনেকেই আশঙ্কা করছেন— যুদ্ধবিরতির আড়ালে গাজায় নতুন প্রশাসন চাপিয়ে দেওয়া হতে পারে, যা তাদের স্বায়ত্তশাসনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে।

অন্যদিকে মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, যুদ্ধাপরাধের দায় নিরূপণ ছাড়া প্রকৃত শান্তি সম্ভব নয়।
তাদের দাবি, ইসরাইলি সেনাবাহিনীর আগ্রাসনের জন্য আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার শুরু করা জরুরি।

বিশ্ব শান্তির পরীক্ষাক্ষেত্র গাজা

গাজা শুধু একটি ভূখণ্ড নয়— এটি আজ বিশ্ব শান্তি ও মানবতার পরীক্ষাক্ষেত্র
যুদ্ধবিরতি কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হলে তা হবে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে এক ঐতিহাসিক পরিবর্তনের সূচনা।
কিন্তু যদি এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়, তবে আবারও রক্তাক্ত সংঘাত ফিরে আসতে পারে, যার ফল ভোগ করতে হবে লক্ষাধিক নিরপরাধ মানুষকে।

গাজায় যুদ্ধবিরতি সমন্বয় কেন্দ্রের নেতৃত্বে স্টিভেন ফ্যাগিনের নিয়োগ যুক্তরাষ্ট্রের এক গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক পদক্ষেপ।
তাঁর অভিজ্ঞতা, আন্তর্জাতিক সমর্থন ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা যদি কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যায়, তবে বহু বছর ধরে যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় শান্তি, স্থিতিশীলতা ও পুনর্গঠনের এক নতুন অধ্যায় শুরু হতে পারে।

তবে বাস্তবতা হলো— শান্তির এই পথ সহজ নয়।
যেখানে প্রতিটি ইটের নিচে লুকিয়ে আছে বেদনা, প্রতিটি শিশুর চোখে দেখা যায় যুদ্ধের দাগ, সেখানে টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে সময়সাপেক্ষ ও কঠিন এক লড়াই।

MAH – 13470 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button