অর্থনীতি

যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম আমদানি, সরকারের বড় পদক্ষেপ

Advertisement

বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রতি বছর সাত লাখ টন করে গম আমদানির উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এই সিদ্ধান্ত নেয়ার পেছনে মূল কারণ হলো যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক নীতি এবং বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার বাণিজ্যঘাটতি কমানো। যদিও গত ২২ বছরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম আমদানির পরিমাণ খুবই কম ছিল, এবার সরকারি পর্যায়ে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে।

গত অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে একটিও গম আমদানি হয়নি। ২২ বছরে মাত্র ২২ লাখ টন গম আমদানি হয়েছে, যা বাংলাদেশের গম আমদানির সামগ্রিক চাহিদার তুলনায় খুবই নগণ্য। অথচ এক বছরে দেশের বিভিন্ন উৎস থেকে প্রায় ৫৯ লাখ টন গম আমদানি হয়।

ইউএস হুইট অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক

গত রোববার বাংলাদেশ সরকার যুক্তরাষ্ট্রের গম রপ্তানিকারক সংস্থা ইউএস হুইট অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক (MoU) স্বাক্ষর করেছে। এতে বলা হয়েছে, আগামী পাঁচ বছর ধরে প্রতি বছর ৭০০ হাজার টন গম আমদানি করা হবে। এটি একদিকে গম আমদানির সরকারি অংশ বাড়াবে, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কিছুটা হলেও কমাবে।

গম আমদানির বর্তমান অবস্থা ও উৎস

বাংলাদেশে প্রধান খাদ্যশস্যের মধ্যে গমের উপর আমদানির নির্ভরতা সবচেয়ে বেশি। দেশের গম উৎপাদন কম হওয়ায় মোট চাহিদার প্রায় ৮৫ শতাংশই আমদানির মাধ্যমে পূরণ করতে হয়। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মোট ৫৯ লাখ টন গম আমদানি হয়েছে, যার মাত্র ৬ শতাংশই সরকারি খাত করেছে। বাকি ৯৪ শতাংশ বেসরকারি খাতের মাধ্যমে এসেছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (NBR) তথ্য অনুযায়ী, এই ৫৯ লাখ টন গম আমদানির জন্য ১৬৩ কোটি মার্কিন ডলার অর্থাৎ প্রায় ২২ হাজার ৩৯১ কোটি টাকার শুল্ক প্রদান করা হয়েছে। এই গম আমদানির উৎস বিশ্বের আটটি দেশ।

গম আমদানির প্রধান দেশসমূহ

  • রাশিয়া: ৪৬%
  • ইউক্রেন: ১৮%
  • কানাডা: ১৯%
  • আর্জেন্টিনা: ৮%
  • বুলগেরিয়া: ৩%
  • রোমানিয়া: ৩%
  • ব্রাজিল: ২%
  • অস্ট্রেলিয়া: ১%

রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে মোট ৬৪ শতাংশ গম আমদানি হয়, যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ এই দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলমান যুদ্ধের কারণে সরবরাহ ঝুঁকির সম্মুখীন হতে পারে।

গমের ধরন ও বাজার মূল্য

বিশ্ববাজারে দুই ধরনের গম পাওয়া যায় — সাধারণ আমিষযুক্ত এবং উচ্চ আমিষযুক্ত। বাংলাদেশে সাধারণত সস্তা, সাধারণ আমিষযুক্ত গমই বেশি আমদানি হয়, যা রুটি ও বেকারি পণ্য তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।

  • সাধারণ আমিষযুক্ত গম: রাশিয়া, ইউক্রেন, বুলগেরিয়া, রোমানিয়া ও ব্রাজিল থেকে আমদানি হয়। প্রতি টনের দাম ২৬৪-২৭৫ মার্কিন ডলারের মধ্যে।
  • উচ্চ আমিষযুক্ত গম: কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া থেকে আমদানি হয়। প্রতি টনের দাম ৩০০-৩১৩ মার্কিন ডলার। এই গম দিয়ে উন্নতমানের বিস্কুট, পরোটা ইত্যাদি তৈরি হয়।
  • আর্জেন্টিনা: দুই ধরনের গম আমদানি হয়, সাধারণ ও উচ্চ আমিষযুক্ত।

যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম আমদানির ইতিহাস

গত অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম আমদানির কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে গত ২২ বছরে মোট ২২ লাখ টন গম আমদানি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে, যার মধ্যে বেসরকারি খাতে আমদানি ১৭ লাখ টনের বেশি। সরকারি খাতে ৩ লাখ টন গম আমদানি করা হয়েছে।

সবচেয়ে বেশি আমদানি হয়েছে ২০১৯-২০ অর্থবছরে, প্রায় সাড়ে চার লাখ টন। বাংলাদেশে আমদানি করে থাকে বেসরকারি কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠান যেমন সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ, নাবিল গ্রুপ। সরকারি খাতে সর্বশেষ আমদানি হয়েছিল ২০১৭ সালে।

বিশেষজ্ঞদের মতামত

ডেল্টা অ্যাগ্রো ফুড ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, বাণিজ্যঘাটতি কমাতে হলে বেসরকারি খাতেও আমদানি বাড়ানো প্রয়োজন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে গমের দাম একটু বেশি হলেও গুণগত মান ভালো। সঠিক প্রণোদনা পেলে বেসরকারিও আমদানি বাড়াতে আগ্রহী হবে।

তাছাড়া তিনি আরও জানান, গম ছাড়াও তুলা, এলপিজি, সয়াবিন এবং ইস্পাতের কাঁচামাল (লোহার টুকরা) আমদানির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র থেকে চার বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত আমদানির সুযোগ রয়েছে। তবে এজন্য সরকারের লজিস্টিকস ও নীতি সহায়তা বাড়ানো প্রয়োজন।

যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম আমদানির সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ

বর্তমানে বাংলাদেশে গমের প্রায় ৮৫% আমদানির উপর নির্ভরশীলতা থাকার ফলে সরবরাহ ও দামের স্থিতিশীলতা অত্যন্ত জরুরি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে প্রধান আমদানি উৎস দুটির সরবরাহ ঝুঁকিতে পড়েছে, যা দেশে গমের বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে। এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে নিয়মিত ও ধারাবাহিক গম আমদানির উদ্যোগ বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য ইতিবাচক।

তবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানির ক্ষেত্রে দাম কিছুটা বেশি হওয়ার কারণে সরকার ও বেসরকারি খাতের মধ্যে সমন্বয় ও সঠিক নীতিমালা প্রয়োজন। যুক্তরাষ্ট্রের গম মানসম্মত ও প্রতিযোগিতামূলক হলে আমদানির পরিমাণ বাড়ার সুযোগ রয়েছে, যা দীর্ঘমেয়াদে বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাসে সহায়ক হবে।

গম আমদানির নতুন দিগন্ত: সরকারের ভূমিকা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

সরকারের তরফে গম আমদানি বৃদ্ধির পরিকল্পনা ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে স্থায়ী চুক্তি স্বাক্ষর ইতিবাচক পদক্ষেপ। এটি শুধু খাদ্য নিরাপত্তা বাড়াবে না, বরং আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের বাণিজ্য অবস্থান শক্তিশালী করবে।

সরকারের উচিত আমদানির জন্য আরও লজিস্টিক সহায়তা নিশ্চিত করা, শুল্ক ও ট্যারিফ নীতিমালা এমনভাবে গঠন করা যাতে বেসরকারি খাতের জন্য আমদানিতে উৎসাহ বাড়ে। পাশাপাশি, গমের স্থানীয় উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কৃষি উন্নয়ন, আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগ এবং কৃষকদের প্রণোদনা নিশ্চিত করতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম আমদানির এই নতুন উদ্যোগ বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। যদিও বর্তমান পরিস্থিতিতে এই আমদানির মাধ্যমে বাণিজ্য ঘাটতি খুব বেশি কমার সম্ভাবনা নেই, কিন্তু এটি দেশের আমদানি বৈচিত্র্য এবং খাদ্যের সরবরাহ স্থিতিশীলতায় সহায়তা করবে।

সঠিক নীতি ও সমন্বয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ দীর্ঘমেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে গম আমদানি বাড়িয়ে খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে পারবে।

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button