
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ-২০২৫ অনুযায়ী আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোনো আসনে একক প্রার্থী থাকলেও আর বিনা ভোটে জয়ের সুযোগ থাকছে না। ভোটারদের হাতে থাকছে ‘না ভোট’ দেওয়ার বিকল্প। অর্থাৎ, প্রার্থী একা থাকলেও জনগণ চাইলে তার বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারবেন।
বৃহস্পতিবার (২৩ অক্টোবর) রাজধানীর বেইলি রোডে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল এই তথ্য জানান। তিনি বলেন, “আগামী জাতীয় নির্বাচনে জনগণের ভোটাধিকার ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে আমরা এই বিধান যুক্ত করেছি। যাতে কেউ একক প্রার্থী হিসেবে বিনা ভোটে সংসদে যেতে না পারে।”
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে বড় পরিবর্তন
নতুন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে বেশ কিছু যুগান্তকারী পরিবর্তন আনা হয়েছে। উপদেষ্টা আসিফ নজরুল জানান, এবার থেকে কোনো আসনে একক প্রার্থী থাকলে সেই প্রার্থীর পক্ষে বা বিপক্ষে ভোট নেওয়া হবে। যদি অধিকাংশ ভোটার ‘না ভোট’ দেন, তাহলে নির্বাচন কমিশন সেই আসনের ফলাফল বাতিল করে পুনর্নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে।
এর পাশাপাশি, নির্বাচনে অংশ নেওয়ার যোগ্যতার ক্ষেত্রেও কঠোরতা বাড়ানো হয়েছে। কোনো পলাতক আসামি সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না। এ ছাড়া প্রার্থীদের জামানত ২০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা করা হয়েছে।
আইন উপদেষ্টা জানান, “আমরা চাই, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক যোগ্য ও গ্রহণযোগ্য প্রার্থীরা। জনগণ যেন তাদের ভোটের মাধ্যমে প্রকৃত প্রতিনিধি বেছে নিতে পারেন।”
বিনা ভোটে জয়ের যুগের অবসান
বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে বহুবার এমন নজির রয়েছে যেখানে কোনো আসনে একক প্রার্থী মনোনীত হওয়ায় ভোটগ্রহণ ছাড়াই প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছেন। বিশেষ করে গত এক দশকে বিনা ভোটে জয় ছিল বড় বিতর্কের বিষয়। এই প্রক্রিয়াকে অনেকেই গণতান্ত্রিক অধিকার ক্ষুণ্ণ করার উদাহরণ হিসেবে দেখেছিলেন।
নতুন এই বিধান সেই বিতর্কের অবসান ঘটাবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, ‘না ভোট’ পদ্ধতি জনগণের হাতে পুনরায় ক্ষমতা ফিরিয়ে দেবে। ভোটাররা চাইলে একক প্রার্থীকে প্রত্যাখ্যান করতে পারবেন, যা নির্বাচনের স্বচ্ছতা ও গণতন্ত্রের মান রক্ষায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
‘না ভোট’ চালুর প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশে ‘না ভোট’ ধারণা নতুন নয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে প্রথমবারের মতো এ পদ্ধতি চালু করা হয়েছিল। তখন ভোটারদের হাতে ছিল এমন একটি বিকল্প—যেখানে কোনো প্রার্থী পছন্দ না হলে তারা ভোট দিতে পারতেন ‘না ভোট’-এ।
তবে পরবর্তীতে আইন সংশোধনের মাধ্যমে এটি বাতিল করা হয়। এবার আবারও সেই ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা হচ্ছে নতুন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে। এ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে আলোচনা চলছে—এটি কি ভোটারদের আস্থা পুনরুদ্ধারে সাহায্য করবে?
অন্যান্য সংশোধন: স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বৃদ্ধি
আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল আরও জানান, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে এবার বেশ কিছু স্বচ্ছতামূলক ধারা সংযোজন করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
- প্রার্থীদের হলফনামায় দেশি ও বিদেশি আয়ের উৎসের বিস্তারিত বিবরণ দিতে হবে।
- নির্বাচন কমিশন সেই তথ্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করবে যাতে জনগণ জানতে পারে কে কত সম্পদের মালিক।
- ইভিএম (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) সংক্রান্ত বিধান বাতিল করা হয়েছে।
- সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞার আওতায় আনা হয়েছে।
- প্রবাসী ভোটারদের জন্য পোস্টাল ব্যালট ভোটিং চালু করা হচ্ছে, যেখানে তারা অনলাইনে নিবন্ধন শেষে ডাকযোগে ভোট দিতে পারবেন।
এসব পদক্ষেপকে অনেকেই গণতন্ত্র ও নির্বাচনী প্রক্রিয়ার প্রতি জনগণের আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার উদ্যোগ হিসেবে দেখছেন।
বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতামত
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হুমায়ুন কবীর বলেন, “একক প্রার্থীর বিনা ভোটে জয়ের বিধান বন্ধ করা গণতন্ত্রের জন্য একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। এর ফলে প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের সংস্কৃতি আবারও ফিরে আসতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, “যদি এই আইনের সঠিক বাস্তবায়ন হয়, তাহলে জনগণের ভোটের গুরুত্ব আরও বাড়বে এবং নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা পুনরুদ্ধার হবে।”
তবে কিছু বিশেষজ্ঞের মত, শুধু আইন প্রণয়ন নয়, তার বাস্তবায়নই হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তারা মনে করেন, ভোটকেন্দ্রে নিরাপত্তা, ভোটার উপস্থিতি ও সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করলেই এই উদ্যোগ সফল হবে।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ-২০২৫ এর নতুন বিধান বাংলাদেশে গণতন্ত্রের একটি নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে। একক প্রার্থীর বিনা ভোটে জয় রোধ করে ভোটারদের হাতে পুনরায় সিদ্ধান্তের ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করবে এবং জনগণের আস্থা পুনর্গঠনে সহায়ক হবে।
তবে শেষ পর্যন্ত এই উদ্যোগের সাফল্য নির্ভর করবে নির্বাচনের পরিবেশ, স্বচ্ছতা এবং বাস্তবায়নের কার্যকারিতার ওপর। এখন দেশের মানুষ তাকিয়ে আছে—নতুন এই আইনি পরিবর্তন কি সত্যিই সুষ্ঠু ভোটের যুগ আনতে পারবে?
এম আর এম – ১৯১১,Signalbd.com