
চাঁদপুরের মতলব উত্তরে সরকার ঘোষিত মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান চলাকালীনও মেঘনা নদীতে নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে অবাধে ইলিশ শিকার করা হচ্ছে। বিশেষ করে রাতের অন্ধকারে জেলেরা কারেন্টজাল ব্যবহার করে ইলিশ ধরছে, এমনকি অপ্রাপ্তবয়স্কদেরও শিকারের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী, ৪ অক্টোবর থেকে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত ষাটনল থেকে চর আলেকজান্ডার পর্যন্ত একশ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে সব ধরনের ইলিশ শিকার, পরিবহন, মজুত ও বিক্রি নিষিদ্ধ। মতলব উত্তরের ষাটনল থেকে আমিরাবাদ পর্যন্ত প্রায় ২৫ কিলোমিটার এলাকায় এই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ রয়েছে।
মাঠপর্যায়ের পরিস্থিতি
স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, প্রশাসনের নিয়মিত নজরদারি না থাকায় বিভিন্ন বাজারে প্রকাশ্যে ইলিশ বিক্রি ও রাতের অন্ধকারে নদীতে অবাধ শিকার চালাচ্ছে অসাধু জেলেরা। দিনের বেলা যদিও নদীতে তেমন কার্যক্রম দেখা যায় না, রাতের সময় ধরা পড়ে না এমন পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে।
মোহনপুর নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মোহাম্মদ আলী জানান, “আমরা প্রতিদিন নদীতে অভিযান চালাচ্ছি। মা ইলিশ রক্ষায় কাউকেই ছাড় দেওয়া হচ্ছে না।” গত ১৭ দিনে এখানে ৩৭টি মামলা হয়েছে, ১২৬ জন জেলে আটক, ৩৪টি ইঞ্জিন চলিত নৌকা জব্দ এবং ৩ কোটি ৮০ লাখ মিটার কারেন্টজাল ধ্বংস করা হয়েছে।
প্রশাসনের অভিযানের পরিসংখ্যান
উপজেলা প্রশাসন ও মৎস্য দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ৪ অক্টোবর থেকে ২০ অক্টোবর পর্যন্ত ১৭ দিনের অভিযানে মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হয় চারটি, অভিযান ৭০টি, ৬ লাখ মিটার কারেন্টজাল জব্দ করা হয়। এ সময় ০.৩০ মেট্রিক টন ইলিশ মাছ উদ্ধার করে স্থানীয় এতিমখানায় বিতরণ করা হয়েছে। অভিযানে ৩ জনকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা ও ৩৪টি মামলা দায়ের করা হয়েছে, ৭৬ জনকে আসামি করা হয়েছে।
বেলতলী নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক জানান, “আমরা অভিযানে ৬ জন জেলেকে আটক করেছি, ৯ লাখ ৮১ হাজার মিটার কারেন্টজাল জব্দ এবং ২০৫ কেজি ইলিশ উদ্ধার করেছি।”
জেলেদের বক্তব্য
কিছু জেলে অভিযোগ করেছেন, সরকারি নিষেধাজ্ঞার সময় বরাদ্দকৃত চাল দিয়ে সংসার চলানো সম্ভব হচ্ছে না। তারা বলছেন, “সন্তানদের না খাইয়ে রাখার চেয়ে নদীতে নামাই শ্রেয়।” স্থানীয় জেলেরা অবশ্য দাবি করেছেন, তারা সরকারি নিয়ম মেনে শিকার করছে, কিন্তু বাইরের জেলার জেলেরা রাতের অন্ধকারে নদীতে প্রবেশ করছে।
মৎস্যজীবী ফুলচান বর্মণ বলেন, “আমরা নিয়ম মেনে চলি, কিন্তু মুন্সিগঞ্জের পশ্চিম পাড়ের জেলেরা অবাধে মাছ ধরে। প্রশাসনের তৎপরতা বাড়াতে হবে।”
প্রশাসনের মত
মতলব উত্তর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও উপজেলা টাস্কফোর্স কমিটির সভাপতি মাহমুদা কুলসুম মনি বলেন, “নদীতে আমরা নিয়মিত টহল দিচ্ছি এবং মৎস্য দপ্তর ও নৌ পুলিশকে নিয়ে যৌথভাবে অভিযান পরিচালনা করছি। নদীর বিস্তৃত এলাকা একসঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন, তবে যে কেউ নিষেধাজ্ঞা অমান্য করবে, তাকে আইনের আওতায় আনা হবে।”
উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তারা প্রতিদিন বাজার, মাছঘাট ও আড়ৎ পরিদর্শন করছেন। তবে নদীর সব পয়েন্টে পর্যাপ্ত জনবল না থাকায় রাতের শিকার পুরোপুরি রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না।
আইনি ও পরিবেশগত প্রভাব
মা ইলিশ সংরক্ষণে সরকারি নিষেধাজ্ঞা কার্যকর না হলে ইলিশের প্রজনন কমে যেতে পারে। এটি নদীর পরিবেশ ও স্থানীয় অর্থনীতির উপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, স্থানীয় প্রশাসন এবং জেলেদের একযোগে কাজ না করলে সংরক্ষণ কার্যক্রম ব্যর্থ হতে পারে।
সমাধানের উপায়
বিশেষজ্ঞদের মতে,
- নদীতে পর্যাপ্ত টহল ও নজরদারি নিশ্চিত করতে হবে।
- স্থানীয় জেলেদের সঙ্গে সমন্বয় বাড়াতে হবে।
- বাইরের জেলার জেলেদের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি।
- মৎস্যজীবীদের বিকল্প জীবিকা এবং প্রণোদনা দেওয়া যেতে পারে।
এতে করে মা ইলিশ সংরক্ষণ কার্যক্রম কার্যকর হবে এবং নদীর জৈবিক ভারসাম্য বজায় থাকবে
মেঘনা নদীতে সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ইলিশ শিকার চললেও প্রশাসন এবং নৌ-পুলিশের অভিযান চলমান। স্থানীয় জেলেদের এবং বাইরের জেলার অসাধু শিকারিদের নিয়ন্ত্রণ না করলে মা ইলিশ সংরক্ষণ কার্যক্রমে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে।
এম আর এম – ১৮৭৩,Signalbd.com