
ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের খোয়াই জেলার সীমান্তবর্তী এলাকায় গরুচোর সন্দেহে তিন বাংলাদেশিকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করেছে স্থানীয় জনতা। নিহত তিনজনই হবিগঞ্জ জেলার বাসিন্দা ও দিনমজুর ছিলেন। এ ঘটনায় সীমান্তজুড়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে এবং বিজিবি–বিএসএফের মধ্যে পতাকা বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
ঘটনার বিবরণ
ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের খোয়াই থানার কারেঙ্গিছড়া এলাকায় বুধবার (১৫ অক্টোবর) সকালে গরুচোর সন্দেহে তিন বাংলাদেশি নাগরিককে স্থানীয়রা পিটিয়ে হত্যা করেছে। নিহতরা হলেন হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার বাসুল্লা গ্রামের পণ্ডিত মিয়া (৪০), কবিলাসপুর গ্রামের সজল মিয়া (২৫) এবং আলীনগর গ্রামের জুয়েল মিয়া (৩৫)। তারা পেশায় দিনমজুর ছিলেন।
বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, ওই তিন বাংলাদেশি সীমান্তের শূন্যরেখা পেরিয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের কারেঙ্গিছড়া এলাকায় প্রবেশ করেছিলেন। এলাকাটি সীমান্তের প্রায় চার থেকে পাঁচ কিলোমিটার ভেতরে, যা ভারতের ৭০ বিএসএফ ব্যাটালিয়নের আওতাধীন। সেখানে স্থানীয়রা তাদের সন্দেহ করে আটক করে এবং পরে গণপিটুনি দেয়। ঘটনাস্থলেই তিনজনের মৃত্যু হয় বলে জানায় ভারতীয় গণমাধ্যম।
খবর পেয়ে ভারতীয় পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতালে পাঠিয়েছে।
সীমান্ত এলাকায় উত্তেজনা ও দুই দেশের যোগাযোগ
ঘটনার পরপরই সীমান্ত এলাকায় উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলা ও পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে নিহতদের আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
৫৫ বিজিবি (হবিগঞ্জ ব্যাটালিয়ন)-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. তানজিলুর রহমান বলেন, “আমরা নিশ্চিত হয়েছি নিহত তিনজনই বাংলাদেশি নাগরিক। বিএসএফের সঙ্গে যোগাযোগ চলছে এবং পতাকা বৈঠক আয়োজনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।”
ত্রিপুরার খোয়াই জেলার পুলিশ সুপার জাস্টিন জোসেফও ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, স্থানীয়রা তিনজনকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু এর আগেই উত্তেজিত জনতা তাদের পিটিয়ে হত্যা করে।
নিহতদের পরিচয় ও গ্রামের শোকাবহ পরিবেশ
হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে এখন শোকের আবহ। নিহত পণ্ডিত মিয়ার বাড়িতে কান্নার রোল পড়েছে। তার স্ত্রী ও সন্তানরা বারবার জ্ঞান হারাচ্ছেন। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য তারেকুর রহমান বলেন, “লাশের ছবি দেখে আমরা নিশ্চিত হয়েছি তারা আমাদের গ্রামের লোক। এমন নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা অকল্পনীয়।”
অন্যদিকে নিহত সজল মিয়া ও জুয়েল মিয়ার পরিবারও খবর পেয়ে ভেঙে পড়েছেন। তারা অভিযোগ করেছেন, তাদের প্রিয়জনরা দিনমজুর হিসেবে কাজের সন্ধানে সীমান্ত এলাকায় গিয়েছিলেন, তারা কোনো অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না।
গরু পাচারের সন্দেহ
বিজিবি ও স্থানীয় প্রশাসনের ধারণা, নিহতরা সম্ভবত সীমান্ত পেরিয়ে গরু আনতে গিয়েছিলেন। সীমান্তবর্তী এলাকায় বহু বছর ধরেই গরু পাচারের ঘটনা ঘটে আসছে। তবে স্থানীয়দের মতে, অনেক সময় নিরপরাধ মানুষকেও গরুচোর সন্দেহে হামলার শিকার হতে হয়।
পূর্বেও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোয় এমন ঘটনা ঘটেছে, যেখানে গরু বা গবাদিপশু চুরির অভিযোগে বাংলাদেশি নাগরিকদের ওপর প্রাণঘাতী হামলা হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, এসব ঘটনার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিচার হয়নি বা যথাযথ তদন্ত হয়নি।
সীমান্তে প্রাণহানির পুনরাবৃত্তি
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে এ ধরনের মৃত্যুর ঘটনা নতুন নয়। মানবাধিকার সংগঠন অধিকার ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান অনুযায়ী, প্রতিবছর গড়ে ৩০ থেকে ৪০ জন বাংলাদেশি সীমান্তে প্রাণ হারান, যাদের মধ্যে অধিকাংশই গরু বা মালামাল পাচারের সন্দেহে বিএসএফ বা স্থানীয় জনতার হাতে নিহত হন।
এই ধরনের ঘটনার কারণে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কেও উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। প্রতিবারই পতাকা বৈঠক হয়, তদন্তের আশ্বাস দেওয়া হয়, কিন্তু মাঠপর্যায়ে তেমন পরিবর্তন দেখা যায় না।
সরকারের প্রতিক্রিয়া ও পরবর্তী পদক্ষেপ
হবিগঞ্জের পুলিশ সুপার (এসপি) এ এন এম সাজেদুর রহমান জানিয়েছেন, “আমরা ত্রিপুরার পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। বিএসএফ ও বিজিবির মধ্যে সমন্বয় করে লাশ হস্তান্তরের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে। ঘটনার বিস্তারিত জানার চেষ্টা চলছে।”
বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, “আমরা ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। সীমান্তে এমন প্রাণঘাতী ঘটনা বন্ধে উচ্চ পর্যায়ে আলোচনা অব্যাহত থাকবে।”
এদিকে মানবাধিকার সংগঠনগুলো এই ঘটনাকে “সীমান্ত হত্যার ধারাবাহিকতা” হিসেবে উল্লেখ করে কঠোর প্রতিবাদ জানিয়েছে। তারা বলছে, দুই দেশের যৌথ সীমান্ত পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী না হলে এই ধরনের হত্যাকাণ্ড বন্ধ হবে না।
সীমান্ত নিরাপত্তা ও মানবাধিকার প্রশ্ন
বিশেষজ্ঞদের মতে, সীমান্ত এলাকায় দীর্ঘদিন ধরেই দারিদ্র্য ও কর্মসংস্থানের অভাবে অনেকেই ঝুঁকিপূর্ণ পথে পা বাড়াচ্ছেন। আর সেই সুযোগে পাচারচক্র সক্রিয় রয়েছে। তবে যে কোনো সন্দেহে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘন।
আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, কোনো দেশের ভেতরে প্রবেশ করা অনুপ্রবেশকারীকেও ন্যায্য বিচার ছাড়া হত্যা করা যায় না। তাই এ ধরনের গণপিটুনির ঘটনা কেবল আইনি নয়, মানবিক প্রশ্নও তোলে।
ত্রিপুরার এই নির্মম ঘটনার পর আবারও সামনে এসেছে সীমান্ত নিরাপত্তা ও মানবাধিকার প্রশ্ন। নিহতদের পরিবার এখন কেবল লাশ ফেরত পাওয়ার অপেক্ষায়। দুই দেশের প্রশাসনের যোগাযোগ চলছে, তবে সীমান্তে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দীর্ঘমেয়াদি সমাধান কতটা বাস্তবায়ন হবে, তা সময়ই বলে দেবে।
এম আর এম – ১৮০৪,Signalbd.com