
বাংলাদেশের জাতীয় পতাকাবাহী সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স লিমিটেড-এর ট্রাফিক হেলপার (ক্যাজুয়াল) পদে লিখিত পরীক্ষা চলাকালে ভয়াবহ এক জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়েছে। পরীক্ষায় প্রকৃত প্রার্থীর পরিবর্তে অন্য ব্যক্তি অংশ নেওয়ায় ১১ জনকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকজন সরাসরি প্রক্সি পরীক্ষার্থী এবং বাকিরা পরীক্ষার নিয়ম ভঙ্গ ও প্রতারণার দায়ে অভিযুক্ত।
বিমান কর্তৃপক্ষ এই ঘটনায় তেজগাঁও ও কাফরুল থানায় পৃথক দুটি মামলা দায়ের করেছে। পাশাপাশি তারা জানিয়েছে, ভবিষ্যতে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় শূন্য সহনশীলতা নীতি (Zero Tolerance Policy) কঠোরভাবে অনুসরণ করা হবে।
কোথায় ও কবে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়
এই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় ১০ অক্টোবর ২০২৫, বিকেল ৩টা থেকে ৪টা পর্যন্ত। পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় দুটি কেন্দ্রে—
- বিএএফ শাহীন কলেজ, জাহাঙ্গীর গেট, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট
- সিভিল এভিয়েশন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, তেজগাঁও, ঢাকা
পরীক্ষায় অংশ নেন কয়েকশত পরীক্ষার্থী। কিন্তু পরীক্ষা চলাকালে সন্দেহজনক আচরণ, প্রবেশপত্রে ছবির অমিল এবং মোবাইল ব্যবহারের ঘটনায় পরীক্ষার হলেই ধরা পড়ে একাধিক অনিয়ম।
কারা বহিষ্কৃত হয়েছেন
বিমানের বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, ১১ জন পরীক্ষার্থীকে পরীক্ষার সময় বহিষ্কার করা হয়। এর মধ্যে বিএএফ শাহীন কলেজ কেন্দ্রে ৭ জন এবং সিভিল এভিয়েশন স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে ৪ জন পরীক্ষার্থী ছিলেন।
নিচে বহিষ্কৃতদের নাম ও অভিযোগ তুলে ধরা হলো—
- রুবা আক্তার — পরীক্ষার হলে মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন।
- সাজাহান হোসেন সজিব — মোবাইল ব্যবহারের অভিযোগে বহিষ্কৃত।
- ইমামুল হক — একই অপরাধে বহিষ্কৃত।
- মো. ফরহাদ হোসেন ফিরোজ — প্রবেশপত্রে ছবির অমিল।
- মো. লাবিব হাসান — প্রবেশপত্রে ছবির অসঙ্গতি।
- মো. শাহিন মিয়া — অন্যের হয়ে পরীক্ষা দিয়েছেন।
- আবদুস সোবাহান — প্রক্সি পরীক্ষার অভিযোগে বহিষ্কৃত।
- মো. রেজওয়ান — অন্যের প্রবেশপত্র ব্যবহার করেন।
- মো. মোকসেদুল — অসদুপায় অবলম্বনের দায়ে বহিষ্কার।
- মো. নজরুল ইসলাম — পরীক্ষার নীতিমালা ভঙ্গ।
- আসাদুল ইসলাম উৎস — একই প্রবেশপত্র ব্যবহার করে দুইবার পরীক্ষা দেওয়ার অভিযোগ।
মামলার বিস্তারিত ও প্রক্সি পরীক্ষার্থীদের পরিচয়
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স জানায়, তেজগাঁও ও কাফরুল থানায় মোট দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে ৫ জন প্রক্সি পরীক্ষার্থী হিসেবে সরাসরি শনাক্ত হয়েছে।
বিস্তারিতভাবে দেখা যায়—
- বিএএফ শাহীন কলেজ কেন্দ্র
- নূর মোহাম্মদ মোল্লার প্রবেশপত্র ব্যবহার করে পরীক্ষা দেয় ইসমাইল হোসেন।
- শারমিন আক্তারের প্রবেশপত্র ব্যবহার করে পরীক্ষা দেয় মোছা. শারমিন নাহার।
- প্রশ্নপত্রের ছবি তোলার দায়ে আটক মো. হানিফ আলী।
- সিভিল এভিয়েশন স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্র
- আব্দুস সোবহানের প্রবেশপত্র ব্যবহার করে পরীক্ষা দেয় মো. রেজাউল ইসলাম।
- মো. রেজওয়ানের প্রবেশপত্র ব্যবহার করে পরীক্ষা দেয় সাদ্দাম হোসেন।
- মো. নজরুল ইসলামের প্রবেশপত্র ব্যবহার করে পরীক্ষা দেয় মাহামুদুল হাসান।
প্রক্সি পরীক্ষার্থীদের পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। অন্যদিকে যাদের নামে প্রবেশপত্র ছিল, তারা পলাতক থাকায় পুলিশ তাদেরও আসামি করেছে।
বিমানের প্রতিক্রিয়া
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের মিডিয়া বিভাগের পক্ষ থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে—
“নিয়োগ পরীক্ষায় কোনো ধরনের জালিয়াতি বা অসদুপায় মেনে নেওয়া হবে না। আমরা এ বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করছি। ভবিষ্যতের পরীক্ষাগুলোতে আরও কঠোর নজরদারি থাকবে।”
বিমান আরও জানিয়েছে, পরীক্ষা চলাকালে পরীক্ষার হলে একাধিক পর্যবেক্ষক ও নিরাপত্তাকর্মী উপস্থিত ছিলেন। তবুও কিছু পরীক্ষার্থী নকল ও প্রক্সির চেষ্টা করে। তাদের দ্রুত চিহ্নিত করে বহিষ্কার করা হয়।
কেন বারবার নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি?
বাংলাদেশে সরকারি ও আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ পরীক্ষায় প্রতিনিয়ত প্রক্সি বা জালিয়াতির ঘটনা ঘটে। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে এখন পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস, মোবাইল যোগাযোগ ও বায়োমেট্রিক প্রতারণা আগের তুলনায় অনেক সহজ হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেকারত্বের চাপ ও প্রতিযোগিতার তীব্রতা এই ধরনের অপরাধে উৎসাহ দেয়। অনেক সময় কিছু পরীক্ষার্থী টাকার বিনিময়ে প্রক্সি ব্যবহার করে চাকরি পাওয়ার চেষ্টা করে।
তবে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের মতো প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের ঘটনা দেশের ভাবমূর্তির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম বলেন,
“যদি নিয়োগ পরীক্ষায় সঠিক প্রার্থীর পরিবর্তে প্রক্সি অংশ নেয়, তাহলে যোগ্যতা বিচার অসম্ভব হয়ে পড়ে। এটি শুধু চাকরিপ্রার্থী নয়, পুরো রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা কমিয়ে দেয়।”
তিনি আরও বলেন, প্রতিটি নিয়োগ পরীক্ষায় বায়োমেট্রিক উপস্থিতি যাচাই ও মুখের ছবি স্ক্যানিং বাধ্যতামূলক করা উচিত, যাতে কেউ অন্যের হয়ে পরীক্ষা দিতে না পারে।
নিয়োগ প্রক্রিয়ায় নতুন ব্যবস্থা আসছে
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স জানিয়েছে, ভবিষ্যতের নিয়োগ পরীক্ষাগুলোতে নিম্নোক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে—
- পরীক্ষার আগে বায়োমেট্রিক যাচাই।
- প্রতিটি হলে সিসিটিভি পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা।
- পরীক্ষার্থীর মুখের সাথে প্রবেশপত্রের ছবি মিলিয়ে যাচাই।
- পরীক্ষার হলে মোবাইল ফোন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
- পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের QR কোড ট্র্যাকিং।
এই ব্যবস্থা নেওয়া হলে ভবিষ্যতে প্রক্সি ও নকলের ঘটনা অনেকাংশে কমে আসবে বলে আশা প্রকাশ করেছে কর্তৃপক্ষ।
সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া
ঘটনাটি প্রকাশের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন,
“যেখানে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের মতো প্রতিষ্ঠান এত সতর্ক, সেখানে যদি ১১ জন প্রক্সি ধরা পড়ে, তবে অন্য জায়গায় কী হচ্ছে?”
ফেসবুক ও এক্স (পূর্বে টুইটার)-এ অনেকে বলেছেন,
“চাকরির জন্য এমন প্রতারণা মানে যোগ্য প্রার্থীদের প্রতি অবিচার।”
বিমানের ভাবমূর্তি ও ভবিষ্যৎ করণীয়
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স দীর্ঘদিন ধরেই দেশের আকাশপথের গৌরব বহন করে আসছে। কিন্তু সাম্প্রতিক এই জালিয়াতির ঘটনা তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়ার ওপর প্রশ্ন তুলেছে।
তবে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া ও পুলিশের সহায়তায় মামলা দায়েরের মাধ্যমে বিমান কর্তৃপক্ষ তাদের দৃঢ় প্রশাসনিক অবস্থান প্রমাণ করেছে।
অর্থনীতি বিশ্লেষকদের মতে, স্বচ্ছ ও মেধাভিত্তিক নিয়োগ প্রক্রিয়া একটি প্রতিষ্ঠানের সাফল্যের মূল ভিত্তি। তাই বিমানের মতো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের উচিত এই ঘটনাকে শিক্ষা হিসেবে নিয়ে ভবিষ্যতে আরও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের নিয়োগ পরীক্ষায় ১১ জন বহিষ্কার ও প্রক্সি পরীক্ষার মামলা শুধু একটি ঘটনা নয়—এটি গোটা নিয়োগ ব্যবস্থার সততার পরীক্ষা।
যদি নিয়োগে প্রতারণা বন্ধ না হয়, তাহলে দক্ষ ও যোগ্য প্রার্থীরা বঞ্চিত হবেন, এবং এর প্রভাব পড়বে দেশের সেবা খাতে ও জাতীয় অর্থনীতিতে।
বিমান কর্তৃপক্ষের দ্রুত পদক্ষেপ একটি ইতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, যা অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকেও অনুপ্রাণিত করবে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা বজায় রাখতে।
MAH – 13273 I Signalbd.com