বিশ্ব

বিদেশি সাহায্য ছাড়াই টিকে আছে আফগান অর্থনীতি

Advertisement

আফগানিস্তানের ইসলামি আমিরাতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাওলানা আমির খান মুত্তাকী ঘোষণা দিয়েছেন যে, তাদের দেশ এখন সম্পূর্ণভাবে বিদেশি সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল নয়। বরং রাষ্ট্রীয় ব্যয়, উন্নয়ন প্রকল্প ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি পুরোপুরি নিজস্ব আয়ে পরিচালিত হচ্ছে। মস্কো ফরম্যাটের সপ্তম বৈঠকে দেওয়া এই বক্তব্যকে অনেক বিশেষজ্ঞ আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক ইতিহাসে এক “আত্মনির্ভরতার যুগান্তকারী ঘোষণা” হিসেবে দেখছেন।

মস্কো ফরম্যাটে আফগানিস্তানের সক্রিয় উপস্থিতি

রাশিয়ার রাজধানী মস্কোতে সোমবার (৭ অক্টোবর) অনুষ্ঠিত হয় “মস্কো ফরম্যাট” নামক বহুপাক্ষিক বৈঠক। এই বৈঠকে অংশ নেয় রাশিয়া, চীন, ইরান, পাকিস্তান, ভারত, মধ্য এশিয়ার কয়েকটি রাষ্ট্রসহ আঞ্চলিক বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি। প্রথমবারের মতো আফগানিস্তানকে আনুষ্ঠানিকভাবে সদস্য হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়, যা দেশটির জন্য একটি বড় কূটনৈতিক অর্জন।

মুত্তাকী তাঁর বক্তব্যের শুরুতে বলেন,
“রাশিয়ান ফেডারেশন এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভকে ধন্যবাদ জানাই, যারা সাহসিকতার সঙ্গে ইসলামি আমিরাতকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই পদক্ষেপ আমাদের মধ্যে কার্যকর সহযোগিতার নতুন দুয়ার খুলেছে।”

আফগানিস্তানের নতুন অর্থনৈতিক বাস্তবতা

পররাষ্ট্রমন্ত্রী মুত্তাকী জানান, একসময় যেখানে আফগানিস্তানের জাতীয় বাজেটে প্রতিবছর ৪–৬ বিলিয়ন ডলার বিদেশি সাহায্য যুক্ত হতো, এখন সম্পূর্ণ অভ্যন্তরীণ আয়ে সেই ঘাটতি পূরণ হচ্ছে। শিল্প, কৃষি, রপ্তানি ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে নতুন গতি এসেছে।

  • দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি) ১৪.৪ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ১৭.৪ বিলিয়ন ডলার হয়েছে।
  • আফগান রপ্তানি ৭০০ মিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। বর্তমানে আফগান পণ্য রপ্তানি হচ্ছে প্রায় ৭০টি দেশে।
  • দেশে কার্যকর কারখানার সংখ্যা ৩,৫০০ থেকে বেড়ে ৬,০০০-এরও বেশি হয়েছে।
  • বিদেশি বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতি ২১ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে ৭ বিলিয়ন ডলার বাস্তবে বিনিয়োগে রূপ নিয়েছে।

মুত্তাকীর দাবি, এসব অর্জন প্রমাণ করে যে আফগানিস্তান এখন এক আত্মনির্ভর অর্থনীতির পথে রয়েছে।

আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও আফগান অবস্থান

আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোর দিয়ে বলেন, আফগানিস্তানের ভূখণ্ড থেকে অন্য কোনো দেশের জন্য হুমকি সৃষ্টি করা হচ্ছে না। যদিও কিছু আন্তর্জাতিক মহল আফগানিস্তানকে “অঞ্চলীয় ঝুঁকি” হিসেবে উপস্থাপন করছে, তিনি সেই প্রচেষ্টা দৃঢ়ভাবে নাকচ করেছেন।

মুত্তাকীর বক্তব্য,
“যারা বলছে আফগানিস্তানে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর ঘাঁটি রয়েছে, তা সঠিক নয়। আমাদের দেশের ভেতরে কোনো গোষ্ঠী নেই যারা বাইরের দেশে সমস্যা তৈরি করছে।”

তবে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে জানান, প্রতিবেশী কিছু দেশে দা’শ (আইএস) ও অন্যান্য গোষ্ঠীর প্রশিক্ষণকেন্দ্র গড়ে উঠেছে, যা ভবিষ্যতে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হতে পারে।

মাদকবিরোধী পদক্ষেপে কঠোর সাফল্য

মুত্তাকী আফগানিস্তানের মাদক নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপের কথাও তুলে ধরেন। তাঁর ভাষায়,
“আমাদের দেশে আফিম চাষ প্রায় শূন্য পর্যায়ে নামিয়ে আনা হয়েছে। তবে দুঃখজনকভাবে অন্যান্য দেশে মাদক উৎপাদন ও পাচার বেড়ে গেছে।”

জাতিসংঘের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, তালেবান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে আফগানিস্তানে আফিম উৎপাদন প্রায় ৯০ শতাংশ কমেছে। এর ফলে ইউরোপ ও এশিয়ার মাদক বাজারে বড় ধরনের পরিবর্তন দেখা দিয়েছে।

পাঁচ বছরের উন্নয়ন কৌশল

প্রথমবারের মতো ইসলামি আমিরাত একটি পাঁচ বছরের জাতীয় উন্নয়ন কৌশল ঘোষণা করেছে। এর মূল লক্ষ্য—

  • উৎপাদন খাতের সম্প্রসারণ
  • রপ্তানি বৃদ্ধির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন
  • সড়ক, রেল ও বিদ্যুৎ অবকাঠামোর উন্নয়ন
  • আঞ্চলিক যোগাযোগ বৃদ্ধি

মুত্তাকী জানান, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে আফগানিস্তান শুধু আত্মনির্ভরশীলই হবে না, বরং আঞ্চলিক বাণিজ্য ও যোগাযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হবে।

কূটনৈতিক ভারসাম্য

আফগানিস্তান বর্তমানে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নিয়ে এক ধরনের কূটনৈতিক চাপের মুখে রয়েছে। পশ্চিমা বিশ্ব এখনো ইসলামি আমিরাতকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি। তবে রাশিয়া, চীন, ইরান, পাকিস্তানসহ অনেক দেশ বাস্তব পরিস্থিতি মেনে নিয়ে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করছে।

বিশ্লেষকদের মতে, মস্কো ফরম্যাটে আফগানিস্তানের আনুষ্ঠানিক অন্তর্ভুক্তি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে দেশের গ্রহণযোগ্যতা আরও বাড়িয়ে তুলেছে।

গাজা প্রসঙ্গ

বক্তব্যের শেষ দিকে মুত্তাকী ফিলিস্তিন প্রসঙ্গেও কথা বলেন। তিনি বলেন,
“আমি আশা করি আলোচনার মাধ্যমে এমন একটি সমাধান আসবে যেখানে ফিলিস্তিনি জনগণ নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণ করতে পারবে এবং শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করবে। যারা গাজায় নির্যাতন বন্ধ করতে পারে, তাদের প্রতি আমার আহ্বান—প্রায়োগিক পদক্ষেপ গ্রহণ করুন।”

এই মন্তব্যে বোঝা যায়, আফগানিস্তান শুধু অর্থনীতি বা আঞ্চলিক নিরাপত্তার বিষয়েই নয়, বরং বৈশ্বিক মানবাধিকার ইস্যুতেও অবস্থান জানাতে চাচ্ছে।

ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ

যদিও মুত্তাকীর বক্তব্য আশাবাদী, তবুও বাস্তবে আফগানিস্তানের সামনে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে।

  • বিদেশি সাহায্য বন্ধ হওয়ার ফলে স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতে সংকট তৈরি হয়েছে।
  • নারীদের শিক্ষা ও কর্মসংস্থান সীমিত থাকায় আন্তর্জাতিক মহলে সমালোচনা চলছে।
  • বিনিয়োগকারীরা রাজনৈতিক অস্থিরতা ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে এখনো উদ্বিগ্ন।

মস্কো ফরম্যাটে আফগানিস্তানের এই আত্মনির্ভর অর্থনীতি ও আঞ্চলিক শান্তির বার্তা নিঃসন্দেহে এক ইতিবাচক পদক্ষেপ। তবে এর টেকসই বাস্তবায়ন নির্ভর করবে আফগানিস্তানের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এবং আঞ্চলিক সহযোগিতার ওপর।

MAH – 13241 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button