
বাংলাদেশের উন্নয়নযাত্রায় একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণ। এই উত্তরণ কেবল কাগজে-কলমে মর্যাদা অর্জন নয়, বরং বাস্তব অর্থে স্বনির্ভরতার পথে যাত্রা। বৃহস্পতিবার ঢাকায় উপদেষ্টা পরিষদ ও সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস স্পষ্টভাবে জানান, “আমরা যেন নিজেদের পায়ে নিজেরা দাঁড়াতে পারি। আমাদের যেন কোনো ধরনের দাসত্ব করতে না হয়। আমরা আর পরনির্ভর থাকতে চাই না।”
তিনি বলেন, বাংলাদেশের সামনে এখন একটাই লক্ষ্য—স্বনির্ভরতা। যত দ্রুত সম্ভব পরনির্ভরশীলতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন অভ্যাসের পরিবর্তন, সৃজনশীলতা, কঠোর পরিশ্রম ও সমন্বিত প্রচেষ্টা।
এলডিসি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ: একটি ঐতিহাসিক অর্জন
বাংলাদেশ ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়। দীর্ঘ প্রায় পাঁচ দশকের প্রচেষ্টা, ধারাবাহিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক অগ্রগতির ফলে এখন দেশটি উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যাওয়ার পথে।
২০২১ সালে জাতিসংঘ আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে যে বাংলাদেশ ২০২৬ সালের মধ্যে এলডিসি থেকে উত্তরণের শর্ত পূরণ করেছে। কোভিড-১৯ মহামারি ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে এই সময়সীমা আরও কিছুটা বাড়ানো হলেও ২০৩১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে সম্পূর্ণভাবে উত্তীর্ণ হতে হবে।
প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসের বক্তব্য অনুযায়ী, এই উত্তরণ কেবল আন্তর্জাতিক মর্যাদা নয়, বরং জাতিকে নতুনভাবে গড়ে তোলার সুযোগ।
স্বনির্ভরতা বনাম পরনির্ভরতা: বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশের অর্থনীতি দীর্ঘদিন ধরে নির্ভর করেছে—
- তৈরি পোশাক শিল্প (RMG)
- প্রবাসী আয়ের রেমিট্যান্স
- কৃষি খাত
কিন্তু এগুলোর ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা ঝুঁকি তৈরি করছে। বিশেষ করে বৈশ্বিক বাজারের অনিশ্চয়তা, জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের কারণে নতুন বিকল্প খুঁজে বের করাই এখন জরুরি।
প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বলেন, “আত্মনির্ভর হতে হলে আমাদের নতুন চিন্তা আনতে হবে, নতুন পথ খুঁজতে হবে। এটা কঠিন হলেও এর ভেতরেই আনন্দ আছে।”
যুবসমাজ ও সৃজনশীলতার শক্তি
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬৫ শতাংশ তরুণ। এই বিপুল তরুণশক্তিই দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ। ড. ইউনূস মনে করেন, তরুণদের উদ্ভাবনী শক্তি ও সৃজনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব।
তিনি বলেন, “আমাদের তারুণ্যের সৃজনশীলতাই আমাদের শক্তি। এই শক্তি কাজে লাগালে আমরা স্বনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তুলতে পারব।”
অর্থনীতির নতুন দিগন্ত: উদ্ভাবন ও উদ্যোক্তা সৃষ্টি
বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখিয়েছে। ই-কমার্স, ফিনটেক, এডটেক, এগ্রিটেকসহ বিভিন্ন খাতে তরুণ উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসছেন। তবে টেকসই স্বনির্ভরতা নিশ্চিত করতে হলে—
- প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনে বিনিয়োগ বাড়ানো
- স্থানীয় শিল্পকে সুরক্ষা ও প্রণোদনা দেওয়া
- রপ্তানির বৈচিত্র্য বৃদ্ধি করা
- গ্রামীণ অর্থনীতিকে আধুনিকীকরণ
প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনা: নীতি ও কৌশল
ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে অনুষ্ঠিত ব্রিফিংয়ে প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, প্রধান উপদেষ্টা সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের স্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন—
- বিদেশি সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে।
- দেশীয় সম্পদ ও দক্ষতা কাজে লাগাতে হবে।
- শিক্ষা, গবেষণা ও প্রশিক্ষণ খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
- কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতকে সমন্বিতভাবে উন্নয়ন করতে হবে।
বিশ্বব্যাপী অভিজ্ঞতা: অন্য দেশের শিক্ষা
বাংলাদেশের মতো অনেক দেশ এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উঠেছে। উদাহরণস্বরূপ:
- ভুটান: টেকসই পর্যটন ও জলবিদ্যুৎ রপ্তানির মাধ্যমে অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জন করেছে।
- ভিয়েতনাম: শিল্পায়ন ও বৈশ্বিক বাজারে বহুমুখী রপ্তানির মাধ্যমে শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে।
- রুয়ান্ডা: প্রযুক্তি খাত ও কৃষি সংস্কারের মাধ্যমে উন্নয়নের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
বাংলাদেশও চাইলে এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারে।
সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ একসঙ্গে
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দীর্ঘদিন ধরে ৬-৭ শতাংশের মধ্যে রয়েছে, যা বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় বেশি। তবে এর পাশাপাশি রয়েছে বড় কিছু চ্যালেঞ্জ:
- জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ
- বৈদেশিক ঋণ বৃদ্ধি
- বেকারত্ব, বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে
- প্রযুক্তিগত দক্ষতার অভাব
- বৈশ্বিক বাজারের প্রতিযোগিতা
ড. ইউনূস মনে করেন, এই চ্যালেঞ্জগুলোর মোকাবিলা করেই নতুন বাংলাদেশ গড়ে উঠবে।
স্বাধীন ও স্বনির্ভর বাংলাদেশ
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষায়, “নতুন বাংলাদেশ মানেই স্বনির্ভর বাংলাদেশ।” জাতি হিসেবে আমাদের হাতে এখন সুযোগ আছে নিজেদের পুনর্গঠনের। তরুণশক্তি, উদ্ভাবন ও কঠোর পরিশ্রমের সমন্বয় ঘটাতে পারলেই বাংলাদেশ সত্যিকারের স্বনির্ভরতা অর্জন করবে।
MAH – 13234 I Signalbd.com