বাংলাদেশ

কক্সবাজার উপকূলে ২৬ জেলের জীবন বাঁচালো নৌ বাহিনী

Advertisement

বঙ্গোপসাগরের উত্তাল ঢেউ আর প্রাণঘাতী ঝুঁকি উপেক্ষা করে টানা পাঁচ দিন সাগরে ভেসে থাকার পর ২৬ জন জেলে জীবিত উদ্ধার হয়েছেন। বাংলাদেশের নৌ বাহিনীর সাহসী সদস্যরা এই বড় ধরনের উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করে জেলেদের তীরে ফিরিয়ে আনেন। ট্রলারের ইঞ্জিন বিকল হয়ে যাওয়ায় তারা সাগরের গভীর জলে অসহায় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছিলেন।

জেলেরা জানিয়েছেন, তারা মাছ ধরতে গিয়ে এমন দুর্ঘটনায় পড়বেন কখনো ভাবেননি। তাদের সঙ্গে পর্যাপ্ত খাবার ও বিশুদ্ধ পানি না থাকায় জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দিন গুনছিলেন তারা। অবশেষে নৌ বাহিনীর তৎপরতায় প্রাণে বেঁচে ফিরেছেন।

ঘটনার শুরু

স্থানীয় সূত্র জানায়, কয়েকদিন আগে কক্সবাজার উপকূল থেকে একটি মাঝারি আকারের ট্রলার বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। তবে ট্রলারের প্রধান ইঞ্জিন হঠাৎ বিকল হয়ে যায়। এর ফলে সাগরের গভীরে তারা আটকা পড়ে। তীব্র বাতাস ও স্রোতের কারণে ট্রলারটি তীরে ফিরতে পারেনি।

প্রায় ৫ দিন ধরে ভেসে থাকা অবস্থায় নৌ বাহিনীর টহল জাহাজ তাদের দেখতে পায় এবং দ্রুত উদ্ধার অভিযান শুরু করে। পরে নিরাপদে কক্সবাজার উপকূলে নিয়ে আসা হয়।

নৌ বাহিনীর নিশ্চিতকরণ

বাংলাদেশ নৌ বাহিনীর মিডিয়া কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কমান্ডার সিয়াম উল হক সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন—
“আমাদের টহল জাহাজ বঙ্গোপসাগরে নিয়মিত অভিযান চালায়। গত কয়েকদিনে ইলিশ শিকার নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে আমরা কাজ করছি। এরই মধ্যে ভাসমান ট্রলার ও জেলেদের চোখে পড়ে। তৎক্ষণাৎ উদ্ধার করে কক্সবাজারে নিয়ে আসা হয়।”

তিনি আরও জানান, এ ঘটনায় বিস্তারিত তদন্ত চলছে। জেলেদের চিকিৎসা ও প্রাথমিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে।

নিষেধাজ্ঞার সময় কেন মাছ ধরতে গিয়েছিল তারা?

৪ অক্টোবর থেকে সারাদেশে ২২ দিনের ইলিশ শিকার নিষেধাজ্ঞা শুরু হয়েছে। এ সময় মা ইলিশ ধরা, বাজারজাত, পরিবহন, মজুত—সবই নিষিদ্ধ।

তবে কিছু অসাধু জেলে ঝুঁকি নিয়ে মাছ ধরতে সাগরে যায়। উদ্ধার হওয়া জেলেদের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নৌ বাহিনী ও কোস্টগার্ড জানায়, নিয়ম ভেঙে মাছ শিকার রোধে একাধিক জাহাজ টহল দিচ্ছে।

ইলিশ সংরক্ষণ ও আইন প্রয়োগ

বাংলাদেশে ইলিশ একটি জাতীয় মাছ। দেশের অর্থনীতি ও রপ্তানি আয়ের একটি বড় অংশ আসে এই মাছ থেকে। তাই সরকার প্রতিবছর নির্দিষ্ট সময়ে মা ইলিশ সংরক্ষণের জন্য কঠোর ব্যবস্থা নেয়।

আইন অনুযায়ী—

  • ২২ দিন মাছ ধরা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
  • আইন ভঙ্গ করলে সর্বোচ্চ ২ বছর কারাদণ্ড বা জরিমানা হতে পারে।
  • এই সময়ে নৌ বাহিনী, কোস্টগার্ড, পুলিশ, মৎস্য দপ্তর একযোগে অভিযান পরিচালনা করে।

এই বছরও একইভাবে ১৭টি যুদ্ধজাহাজ, কোস্টগার্ড টহল এবং স্থানীয় প্রশাসনের নজরদারিতে অভিযান চলছে।

জেলেদের অসহায়তা

তবে বাস্তবতা হলো, উপকূলের হাজারো জেলে মৌসুমি মাছ শিকারের উপর নির্ভরশীল। নিষেধাজ্ঞার সময় তাদের জীবিকা সংকটে পড়ে। সরকার থেকে ভিজিএফ কর্মসূচির আওতায় চাল দেওয়া হলেও তা অনেক সময় পর্যাপ্ত হয় না।

অনেক জেলে অভিযোগ করেন, নিষেধাজ্ঞার সময় তারা প্রকৃত সহায়তা পান না। ফলে জীবিকার চাপে ঝুঁকি নিয়ে সাগরে মাছ ধরতে যান। এই ট্রলারের জেলেরা হয়তো একই কারণে সমুদ্রে গিয়েছিলেন বলে ধারণা স্থানীয়দের।

অতীতের অনুরূপ ঘটনা

এটি প্রথম নয়। বঙ্গোপসাগরে প্রায়ই ইঞ্জিন বিকল, ঝড়ের কবল বা দিক হারিয়ে জেলেদের ভেসে থাকার ঘটনা ঘটে।

  • ২০২৩ সালে টেকনাফ উপকূলে ৩০ জন জেলে নিখোঁজ হন; পরে কয়েকজনকে উদ্ধার করা হয়।
  • ২০২৪ সালে মহেশখালীর কাছে ঝড়ের কবলে পড়ে ৪০ জন জেলে ভেসে যান, তবে নৌ বাহিনীর তৎপরতায় তারা প্রাণে বাঁচেন।

এই ঘটনাগুলো উপকূলীয় অঞ্চলের জেলেদের জন্য সতর্কবার্তা।

নৌ বাহিনীর মানবিক ভূমিকা

বাংলাদেশ নৌ বাহিনী শুধু সীমান্ত রক্ষা বা যুদ্ধ প্রস্তুতিই নয়, মানবিক সহায়তা ও দুর্যোগ মোকাবেলায়ও বড় ভূমিকা রাখে। ঘূর্ণিঝড়, জাহাজডুবি, জেলে উদ্ধার, এমনকি বন্যা ও ভূমিকম্পে সহায়তাও তারা করে থাকে।

এই ঘটনার পর স্থানীয়রা নৌ বাহিনীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। তারা বলেছেন—“নৌ বাহিনী না থাকলে হয়তো এরা কেউই বাঁচতে পারত না।”

কক্সবাজারের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব

কক্সবাজার উপকূল বাংলাদেশে অন্যতম দীর্ঘ সমুদ্রসৈকত এলাকা। এখানে হাজার হাজার জেলে মাছ শিকারে নির্ভরশীল। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক জাহাজ চলাচলের কারণে এই সমুদ্রসীমা কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নৌ বাহিনী তাই সর্বদা টহল জোরদার রাখে।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও করণীয়

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন—

  • জেলেদের নিরাপত্তার জন্য প্রতিটি ট্রলারে আধুনিক জিপিএস ও যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকা জরুরি।
  • নিষেধাজ্ঞার সময়ে জেলেদের পর্যাপ্ত খাদ্য সহায়তা দিতে হবে।
  • সমুদ্রে দুর্ঘটনা কমাতে প্রশিক্ষণ ও সুরক্ষা সামগ্রী সরবরাহ করতে হবে।

জেলেদের অভিজ্ঞতা

উদ্ধার হওয়া কয়েকজন জেলে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেছেন—
“আমরা ভেবেছিলাম আর ঘরে ফিরতে পারবো না। খাওয়ার পানি শেষ হয়ে যাচ্ছিল। ঢেউয়ের মধ্যে আমরা শুধু দোয়া করছিলাম। নৌ বাহিনী এসে আমাদের জীবন ফিরিয়ে দিলো।”

এই ঘটনা আবারও প্রমাণ করল—বাংলাদেশ নৌ বাহিনী শুধু সীমান্ত নয়, মানুষের জীবন বাঁচাতেও অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। জেলেদের জীবনের ঝুঁকি কমাতে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা, সরকারি সহায়তা ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ আরও নিরাপদে জীবিকা নির্বাহ করতে পারবে।

MAH – 13221 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button