
পবিত্র রমজান মুসলমানদের জীবনের অন্যতম মহিমান্বিত মাস। সারা বিশ্বের কোটি কোটি মুসলমান অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন এ মাসের জন্য। ইবাদত, আত্মশুদ্ধি, দান-খয়রাত, পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করা এবং মানবতার বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য এই মাসের গুরুত্ব অপরিসীম।
সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত জ্যোতির্বিদদের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৬ সালের রমজান মাস শুরু হওয়ার সম্ভাব্য তারিখ ১৭ ফেব্রুয়ারি, মঙ্গলবার। গালফ নিউজসহ মধ্যপ্রাচ্যের একাধিক গণমাধ্যমে জানানো হয়েছে যে, আরব বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে ১৬ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় চাঁদ দেখা যেতে পারে। তবে, ইসলামী শরীয়ত অনুসারে রমজান শুরুর চূড়ান্ত ঘোষণা দেওয়া হবে কেবলমাত্র চাঁদ দেখার পরই।
রমজান কিভাবে শুরু হয়?
রমজান মাস শুরু ও শেষ হওয়ার মূল ভিত্তি হলো চন্দ্রদর্শন। ইসলামি ক্যালেন্ডার বা হিজরি সন হলো চন্দ্রপঞ্জিকা, যা সৌর বর্ষপঞ্জিকার (গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার) তুলনায় প্রায় ১০–১১ দিন ছোট। এজন্য প্রতিবছর রমজান গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে ১০–১১ দিন আগে চলে আসে।
উদাহরণস্বরূপ:
- ২০২৪ সালে রমজান শুরু হয়েছিল ১১ মার্চে
- ২০২৫ সালে শুরু হয়েছিল ১ মার্চে
- ২০২৬ সালে শুরু হওয়ার সম্ভাবনা ১৭ ফেব্রুয়ারি
এই ধারাবাহিকতায় ২০২৭ সালে রমজান শুরু হবে জানুয়ারির শেষে বা ফেব্রুয়ারির শুরুতে।
বিশ্বব্যাপী রমজান শুরুর প্রক্রিয়া
প্রতিটি দেশেই আলাদাভাবে চাঁদ দেখা কমিটি বা ধর্ম বিষয়ক কর্তৃপক্ষ থাকে। তারা শাবান মাসের ২৯ তারিখে আকাশ পর্যবেক্ষণ করে চাঁদ দেখার চেষ্টা করেন।
- সৌদি আরব: মক্কা-মদিনা কেন্দ্রিক চাঁদ দেখা কমিটির ঘোষণা বিশ্বজুড়ে মুসলমানদের জন্য বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।
- বাংলাদেশ: ইসলামিক ফাউন্ডেশন এবং জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটি ঢাকা থেকে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে থাকে।
- ভারত, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়াসহ অন্যান্য দেশেও নিজ নিজ কর্তৃপক্ষ চাঁদ দেখা নিশ্চিত করে।
ফলে অনেক সময় দেখা যায়, এক দেশে রমজান শুরু হলেও অন্য দেশে তা একদিন পরে শুরু হয়।
রমজানের তাৎপর্য
রমজান মাসে মুসলমানরা সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোজা রাখেন। শুধু খাওয়াদাওয়া থেকে বিরত থাকা নয়, বরং মিথ্যা, গীবত, অশ্লীলতা ও অন্যায় কাজ থেকেও বিরত থাকা রোজার অন্যতম শর্ত।
কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
“হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।” (সূরা বাকারা: ১৮৩)
রমজান হলো—
- আত্মশুদ্ধির মাস
- দান-সদকা করার শ্রেষ্ঠ সময়
- তারাবিহ নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের সুযোগ
- লাইলাতুল কদরের মতো মহিমান্বিত রাত লাভের মাস
ঋতুভেদে রমজানের অভিজ্ঞতা
চাঁদের ক্যালেন্ডার সৌর বর্ষপঞ্জিকার তুলনায় ছোট হওয়ায় রমজান কখনো গ্রীষ্মে, কখনো শীতে, কখনো বর্ষায় আসে। এর ফলে ভৌগোলিক অবস্থান ও আবহাওয়ার কারণে মুসলমানদের অভিজ্ঞতা ভিন্ন হয়ে থাকে।
- গ্রীষ্মকালে দীর্ঘ সময় রোজা রাখতে হয়।
- শীতে রোজার সময় তুলনামূলক ছোট হয়, তবে ঠান্ডা আবহাওয়া অন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করে।
- বাংলাদেশের মতো দেশে বর্ষার সময় রোজায় পরিবেশ ভিন্ন স্বাদ এনে দেয়।
২০২৬ সালের রমজান পড়বে শীতের শেষে ও বসন্তের শুরুতে। ফলে দিনের দৈর্ঘ্য তুলনামূলক ছোট থাকবে, যা রোজাদারদের জন্য কিছুটা সুবিধাজনক হতে পারে।
বাংলাদেশে রমজান: ধর্মীয় আবেগ ও সংস্কৃতি
বাংলাদেশে রমজান মাসকে ঘিরে বিশেষ এক আবহ তৈরি হয়।
- মসজিদগুলোতে ইবাদতে ভরে ওঠে।
- ইফতারের সময় রাস্তা থেকে শুরু করে ঘরে ঘরে জমে ওঠে বিশেষ আয়োজন।
- ছোলা, পেঁয়াজু, বেগুনি, জিলাপি— এসব খাবারের সাথে জড়িয়ে আছে রমজানের স্মৃতি।
- লাইলাতুল কদর উপলক্ষে দেশের প্রতিটি মসজিদে লাখো মুসল্লি নামাজে অংশ নেন।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট
আরব বিশ্বে রমজান পালনের ধরণ বাংলাদেশের তুলনায় কিছুটা ভিন্ন। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে দীর্ঘ তারাবিহ নামাজ, ঐতিহ্যবাহী খাবার, পরিবারকেন্দ্রিক ইফতার ও সেহরির আয়োজন অত্যন্ত জনপ্রিয়।
- সৌদি আরব: হারামাইন শরিফাইন (মক্কা-মদিনা) রমজানে মুসলমানদের জন্য সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান।
- তুরস্ক: রমজানে সেহরির আগে ঢোল বাজিয়ে মানুষকে জাগানোর ঐতিহ্য এখনও প্রচলিত।
- মিশর: রাস্তাঘাট সাজানো হয় রঙিন ফানুস দিয়ে।
বৈজ্ঞানিকভাবে রমজানের তারিখ নির্ধারণ
আধুনিক জ্যোতির্বিদ্যা চাঁদ দেখা সহজ করে তুলেছে। জ্যোতির্বিদরা আগে থেকেই নির্ধারণ করতে পারেন চাঁদ কোন দিনে দৃশ্যমান হবে। তবে ইসলামী শরীয়তে প্রত্যক্ষ চাঁদ দর্শনকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। এজন্য সৌদি আরবসহ অনেক দেশ উন্নত প্রযুক্তির পাশাপাশি সাক্ষ্যপ্রমাণ ও প্রত্যক্ষ দর্শনকে গুরুত্ব দেয়।
২০২৬ সালের রমজানের সম্ভাব্য সময়সূচি (বাংলাদেশের জন্য)
- রমজান শুরু: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৬ (মঙ্গলবার) – সম্ভাব্য
- রমজান শেষ: ১৮ মার্চ ২০২৬ (বুধবার) – সম্ভাব্য
- ঈদুল ফিতর: ১৯ মার্চ ২০২৬ (বৃহস্পতিবার) – সম্ভাব্য
(চূড়ান্ত তারিখ জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটি ঘোষণা করবে)
২০২৬ সালের রমজান শুরু হওয়ার সম্ভাব্য তারিখ ইতোমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নির্ভর করবে আকাশে চাঁদ দেখার ওপর। পৃথিবীর মুসলমানরা এ মাসের জন্য অপেক্ষা করে হৃদয়ের গভীর টান থেকে। রোজা শুধু ইবাদতের মাস নয়, এটি মানুষকে সংযম, ধৈর্য, দানশীলতা ও ভ্রাতৃত্ববোধ শেখায়।
রমজান ২০২৬ মুসলমানদের জন্য হবে নতুন এক আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা, যেখানে তারা আবারও আল্লাহর রহমত, মাগফিরাত ও নাজাত লাভের আশায় মগ্ন হবেন।
MAH – 12415 , Signalbd.com