বানিজ্য

আফগানিস্তানে আফিম ছেড়ে জাফরান চাষে তালেবান

Advertisement

আফগানিস্তান দীর্ঘদিন ধরেই আফিম চাষের জন্য আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে রয়েছে। আফিম, যা মূলত অবৈধ ড্রাগ হিসেবে পরিচিত, দেশের অর্থনীতিতে একটি বিতর্কিত অবদান রাখে। যদিও আফগানিস্তান বিশ্বের সবচেয়ে বড় আফিম উৎপাদক দেশ হিসেবে খ্যাত, তবে দেশটির স্থানীয় কৃষক ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর জন্য এটি দীর্ঘকাল ধরে একটি বড় সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এই পরিস্থিতিতে আফগানিস্তানের তালেবান সরকার একটি নতুন কৃষি উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। দেশটির বিভিন্ন জেলায় আফিম চাষ বন্ধ করার এবং কৃষকদের বিকল্প জীবিকা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এবার জাফরান চাষকে এগিয়ে আনা হচ্ছে। বিশেষভাবে খাকরেজ, নিশ, মারুফ, দামান এবং মিয়ান-এ-শিন জেলায় এই উদ্যোগ কার্যকর হচ্ছে।

জাফরান চাষ: আফগান কৃষিতে নতুন দিগন্ত

জাফরান, যা বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান মসলা হিসেবে পরিচিত, আফগানিস্তানের জলবায়ু এবং মাটি উভয়ের জন্যই খুবই উপযুক্ত। তালেবান সরকারের মতে, জাফরান চাষ আফিমের বিকল্প হিসেবে একটি নিরাপদ এবং লাভজনক প্রজেক্ট। সরকারের আশা, এটি কৃষকদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে এবং দেশের কৃষি খাতে বৈচিত্র্য আনবে।

কান্দাহারের কৃষি, সেচ ও প্রাণিসম্পদ বিভাগের মুখপাত্র মোহাম্মাদ হানিফ হাকমাল জানিয়েছেন, “এই বছর খাকরেজ, নিশ, মারুফ, দামান এবং মিয়ান-এ-শিন জেলায় জাফরান চাষ শুরু হয়েছে। এটি এমন একটি প্রোগ্রামের অংশ, যার উদ্দেশ্য বিকল্প জীবিকা নিশ্চিত করা এবং আফিম চাষ প্রতিহত করা।”

তিনি আরও উল্লেখ করেন, “জাফরান চাষের মোট খরচ হয়েছে প্রায় ৭,০৬০,০০০ আফগানি। এছাড়া কৃষকদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য দুই দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ কর্মশালাও অনুষ্ঠিত হয়েছে, যেখানে চাষের সঠিক পদ্ধতি, উৎপাদন বৃদ্ধি এবং বাজারজাতকরণের প্রক্রিয়া শেখানো হয়েছে।”

আফিম চাষের ইতিহাস এবং সমস্যাসমূহ

আফগানিস্তানে আফিম চাষের ইতিহাস বহু দশক ধরে চলে আসছে। বিশেষ করে পত্রকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর রিপোর্ট অনুযায়ী, আফিম দেশের কৃষি অর্থনীতিতে একটি উল্লেখযোগ্য অংশ রয়েছে, তবে এর ফলে নানা সামাজিক ও নিরাপত্তা সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। আফিম চাষে স্থানীয় কৃষকরা অনেক সময় অপরাধী জালিয়াতি ও আন্তর্জাতিক ড্রাগ ট্রাফিকিংয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।

বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থা দীর্ঘদিন ধরে আফগানিস্তানের কৃষকদের বিকল্প চাষের প্রস্তাব দিচ্ছিল। তালেবান সরকারও এই সমস্যা সমাধানে চরম উদ্যোগ নিলেই তা ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে ধরা হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও পিস্তা বাগান উদ্যোগ

জাফরান ছাড়াও, আফগানিস্তানের কৃষকরা বিভিন্ন ধরনের বিকল্প চাষে মনোনিবেশ করছে। আন্তর্জাতিক ড্রাগ কন্ট্রোল সংস্থা আফগানিস্তানের উপরের শাওয়ালিকোট, নীচের শাওয়ালিকোট, নিশ এবং মিয়ান-এ-শিন জেলায় পিস্তা বাগান স্থাপন করেছে। এই উদ্যোগের লক্ষ্য, কৃষকদের স্থায়ী এবং লাভজনক বিকল্প জীবিকা প্রদান করা।

মুখ্যত, পিস্তা ও জাফরান চাষ আফগানিস্তানের জন্য এক নতুন অর্থনৈতিক দিগন্ত খুলে দেবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি কৃষকরা সঠিকভাবে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং বাজারজাতকরণের জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহায়তা পান, তবে আফগানিস্তান আফিমের উপর নির্ভরতা কমাতে পারবে।

কৃষকদের প্রতিক্রিয়া

স্থানীয় কৃষকরা এই নতুন উদ্যোগকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন। এক কৃষক বলেছেন, “আমরা দীর্ঘদিন আফিম চাষ করে আসছি, কিন্তু এটি অনেক ঝুঁকিপূর্ণ এবং নিরাপদ নয়। জাফরান চাষে আমাদের জন্য একটি নিরাপদ এবং লাভজনক বিকল্প এসেছে।”

অন্যদিকে, অনেক কৃষক আশা করছেন, সরকার যেন এই নতুন প্রকল্পে পর্যাপ্ত অর্থায়ন এবং বাজারের নিশ্চয়তা প্রদান করে। কারণ, সঠিক বাজার না থাকলে চাষের অর্থনৈতিক সুবিধা সীমিত হতে পারে।

আফগান কৃষিতে সম্ভাবনা

জাফরান চাষের মাধ্যমে আফগানিস্তানের কৃষি খাতে নতুন সম্ভাবনা উন্মোচিত হচ্ছে। দেশের মাটির উর্বরতা, জলবায়ু এবং কৃষকদের দক্ষতা মিলিয়ে জাফরান চাষ একটি লাভজনক উদ্যোগ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আফগানিস্তানের জন্য এটি শুধু অর্থনৈতিক পরিবর্তন নয়, সামাজিক ও নিরাপত্তার জন্যও একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। আফিম চাষ বন্ধ করলে কৃষকদের অপরাধের সাথে জড়িত হওয়ার সম্ভাবনা কমবে এবং শিশু শ্রমও হ্রাস পাবে।

চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

তবে জাফরান চাষে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। যেমন, সঠিক সেচ ব্যবস্থা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বাজারজাতকরণ এবং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা। তাই তালেবান সরকার এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো একত্রিতভাবে কাজ করে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে চায়।

আফগান সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, আগামী বছর আরও বেশি জেলায় জাফরান চাষ সম্প্রসারণ করা হবে। এছাড়া কৃষকদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি এবং বীজ সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে।

আফগানিস্তানে আফিম চাষ বন্ধের প্রচেষ্টা একটি বড় এবং চ্যালেঞ্জিং উদ্যোগ। তবে তালেবান সরকারের জাফরান চাষ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তা দেশের কৃষকদের জন্য নতুন দিক নির্দেশ করছে। বিকল্প জীবিকা নিশ্চিত হওয়া, অর্থনৈতিক উন্নয়ন বৃদ্ধি এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এই উদ্যোগের মূল লক্ষ্য।

এভাবে আফগান কৃষি খাত শুধুমাত্র অর্থনৈতিক দিক দিয়ে নয়, সামাজিক ও আন্তর্জাতিক দিক থেকেও একটি সুস্থ এবং টেকসই পরিবর্তনের দিকে এগোচ্ছে।

MAH – 13184 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button