বিশ্ব

গাজায় ইসরায়েলের সতর্কবার্তা: যারা থাকবে, তারা ‘সন্ত্রাসী’

Advertisement

গাজা, ফিলিস্তিন – দখলদার ইসরায়েল গতকাল বুধবার গাজার প্রধান শহরের বাসিন্দাদের উদ্দেশ্যে চূড়ান্ত সতর্কবার্তা জারি করেছে। ইসরায়েলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, যেসব নাগরিক দক্ষিণের দিকে সরতে চান, তারা যেন দ্রুত নিরাপদ এলাকায় যান। যারা এই নির্দেশ অমান্য করবেন, তাদের ‘সন্ত্রাসী এবং সন্ত্রাসের সমর্থক’ হিসেবে গণ্য করা হবে।

এ সময় গাজা অঞ্চলে কয়েক বছরের সংঘাতের পর শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা নিয়ে আলোচনা চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় প্রস্তাবিত শান্তি পরিকল্পনা নিয়ে হামাসের নেতারা বৈঠক করছে।

গাজা শহরে তীব্র বোমাবর্ষণ ও অবরোধ

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান জানিয়েছে, গাজার শহরবাসী তীব্র বোমাবর্ষণ ও বিমান হামলার মুখোমুখি। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, প্রতিদিন বোমার শব্দ এবং বিস্ফোরণ শহরের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছে।

ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে লিখেছেন, “এটা গাজার বাসিন্দাদের জন্য শেষ সুযোগ। যারা যেতে চান, তারা দক্ষিণে চলে যান। শহরে অব্যাহত থাকলে, তাঁরা সন্ত্রাসী ও সন্ত্রাস সমর্থক হিসেবে গণ্য হবেন।”

কাৎজ আরও জানিয়েছেন, নেতজারিম করিডর ইসরায়েলি সেনারা দখল করেছে। এর ফলে মধ্য গাজা থেকে পশ্চিম উপকূল পর্যন্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে। এই করিডরের মাধ্যমে দক্ষিণে যেতে চাইলে নাগরিকদের ইসরায়েলি তল্লাশি চৌকি পেরোতে হবে। এছাড়া, উত্তরে যাওয়ার শেষ পথও বন্ধ করা হয়েছে।

গাজার সাধারণ মানুষের দুর্দশা

গাজার আল-শিফা হাসপাতাল প্রাঙ্গণে আশ্রয় নেওয়া ৬০ বছর বয়সী রবাহ আল-হালাবি বলেন, “চারপাশে একটানা বিস্ফোরণ চলছে। দক্ষিণেও বোমাবর্ষণ সমানভাবে ভয়াবহ। আমরা যেভাবে থাকব, মৃত্যুর সম্ভাবনা ততটাই বাড়বে।”

তিনি আরও বলেন, “আমরা কেবল ঈশ্বরের দয়া বা যুদ্ধবিরতি আশা করতে পারি। এখন আমাদের জন্য প্রতিটি মুহূর্ত আতঙ্কে ভরা।” হামাস এই মন্তব্যকে যুদ্ধাপরাধ বৃদ্ধির পূর্বাভাস হিসেবে দেখেছে।

আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর উদ্বেগ

আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটি জানিয়েছে, গাজার সামরিক অভিযানের তীব্রতার কারণে তাদের কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। এর আগে ডক্টরস উইদাউট বর্ডারসও কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছিল। তবে কিছু জাতিসংঘ সংস্থা এবং ত্রাণ সংগঠন এখনও ত্রাণ ও সহায়তা কার্যক্রম চালাচ্ছে।

ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনা ও হামাসের অবস্থান

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রস্তাবিত শান্তি পরিকল্পনার মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি, ৭২ ঘণ্টার মধ্যে জিম্মিদের মুক্তি, হামাসের নিরস্ত্রীকরণ এবং ধাপে ধাপে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহারের বিষয়টি নিশ্চিত করতে চাচ্ছেন।

হামাসের একটি ঘনিষ্ঠ ফিলিস্তিনি সূত্র জানিয়েছে, এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। পরিকল্পনা পর্যালোচনায় আরও দুই-তিন দিন সময় লাগতে পারে। সূত্রের দাবি, হামাস নিরস্ত্রীকরণ এবং তৎপরভাবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ শর্ত পরিবর্তন করতে চাচ্ছে। তারা নিশ্চিত করতে চায়, ইসরায়েল সেনা পুরোপুরি প্রত্যাহার করবে এবং যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ হবে না।

গাজার নাগরিকদের নিরাপত্তা ও হতাহতের তথ্য

গাজার সিভিল ডিফেন্স সংস্থা জানিয়েছে, বুধবারের ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ৪৬ জন নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ৩৬ জন গাজার শহরে। স্কুল আশ্রয়কেন্দ্রে হামলায় আটজন নিহত হয়েছেন। তবে ইসরায়েলি সেনারা দাবি করেছেন, ওই এলাকায় হামলা চালানো হয়েছিল হামাস যোদ্ধাকে লক্ষ্য করে, এবং বেসামরিক লোকদের ক্ষতি এড়ানোর জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়েছে।

গাজার সংবাদ নিয়ন্ত্রণ ও প্রবেশের সীমাবদ্ধতার কারণে হতাহতদের সংখ্যা স্বাধীনভাবে যাচাই করা সম্ভব হচ্ছে না। ২৬ বছর বয়সী ফাদেল আল-জাদবা বলেন, “আমরা যেকোনো মূল্যে যুদ্ধবিরতি চাই। আমাদের মানুষ ক্লান্ত, হতাশ, এবং পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ নেই।”

বুধবার রাতে ইসরায়েলি সেনারা জানিয়েছে, গাজার থেকে ইসরায়েলের দিকে পাঁচটি ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়েছে। এর মধ্যে চারটি আটকানো হয়েছে, একটি খোলা জায়গায় পড়ে।

হামাসে দুই মত

দোহায় আলোচনার সঙ্গে যুক্ত এক সূত্র জানিয়েছে, হামাসের ভেতরে দুটি মতামত বিরাজ করছে।

  1. প্রথম দল: যুদ্ধবিরতিকে অগ্রাধিকার দিয়ে ট্রাম্পের পরিকল্পনা নিঃশর্তে গ্রহণ করা উচিত।
  2. দ্বিতীয় দল: পরিকল্পনার কিছু গুরুত্বপূর্ণ ধারা, যেমন নিরস্ত্রীকরণ ও গাজা থেকে উৎখাতের শর্ত, প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা শর্তসাপেক্ষে অনুমোদন দিতে চাচ্ছে।

সংঘাতের ইতিহাস ও পরিসংখ্যান

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের ইসরায়েলে হামলায় ১,২১৯ জন নিহত হন, যার অধিকাংশই সাধারণ মানুষ। প্রতিশোধমূলক অভিযানে এখন পর্যন্ত অন্তত ৬৬,১৪৮ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, নিহতদের অর্ধেকের বেশি নারী ও শিশু, যদিও তালিকায় যোদ্ধা ও সাধারণ মানুষ আলাদা করে দেখানো হয়নি।

গাজার মানুষ ও ভবিষ্যৎ

গাজার শহরবাসী এখন আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। অনেকেই দক্ষিণে সরার পথ খুঁজছেন, কেউ কেউ স্থির থাকার চেষ্টা করছেন। শিশু, নারী ও বৃদ্ধরা সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী।

বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার সংস্থা ও শান্তিচেষ্টা সংস্থাগুলো উদ্বিগ্ন, এবং গাজার স্থিতিশীলতা ও সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।

সংক্ষেপে:

  • গাজার শহরে ইসরায়েলের তীব্র বোমাবর্ষণ ও অবরোধ।
  • গাজার নাগরিকদের জন্য দক্ষিণে সরার নির্দেশ, না মানলে সন্ত্রাসী হিসেবে গণ্য।
  • ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় শান্তি পরিকল্পনা; হামাসের মধ্যে দ্বৈত মত।
  • গাজার স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা সংস্থা, জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো কার্যক্রম চালাচ্ছে।
  • সংঘাতের ইতিহাস: হাজার হাজার ফিলিস্তিনি নিহত, নারী ও শিশু সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত।

MAH – 13125 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button