বানিজ্য

তরিকুল–শাহজাবিন দম্পতির জুতার উদ্যোগ, বার্ষিক লেনদেন ৮ কোটি টাকা

Advertisement

পাবনার ফরিদপুরের ছোট্ট গ্রামের সন্তান তরিকুল ইসলাম ও তাঁর স্ত্রী শাহজাবিন হকের উদ্যোগে যাত্রা করা জুকো ব্র্যান্ডের জুতা এখন দেশের ই–কমার্স ও ফিজিক্যাল মার্কেটে সাড়া ফেলেছে। মাত্র ৯০ হাজার টাকা মূলধন দিয়ে শুরু হওয়া এই ব্যবসা আজ প্রায় ৮ কোটি টাকার বার্ষিক লেনদেনে পৌঁছেছে। তাদের উদ্যোগ কেবল ব্যবসায়িক সাফল্যের দৃষ্টান্ত নয়, বরং স্বপ্ন পূরণের প্রেরণাও জোগাচ্ছে।

তরিকুল–শাহজাবিনের উদ্যোগের সূচনা

২০১৫ সালে হিসাববিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর শেষে তরিকুল ইসলাম নর্দান ইউনিভার্সিটি থেকে বিপণন বিষয়ে এমবিএ ডিগ্রি লাভ করেন। চাকরিজীবনের অভিজ্ঞতা এবং ই–কমার্স খাতের প্রতি আগ্রহের কারণে ২০১৯ সালে তিনি একটি ছোট ই–কমার্স প্রতিষ্ঠানে কাজ শুরু করেন। শুরুতে প্রতিষ্ঠানটি কেবল টি–শার্ট বিক্রির উপর নির্ভরশীল ছিল।

২০২০ সালে করোনা মহামারির প্রভাব এবং চাকরি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তরিকুল এবং শাহজাবিন সিদ্ধান্ত নেন নিজেদের ব্যবসা শুরু করার। নিজেরা মিলিতভাবে ব্যবসা শুরু করার জন্য তরিকুলকে স্ত্রী শাহজাবিন ৯০ হাজার টাকা দিয়ে সমর্থন করেন। এই মূলধন দিয়ে শুরু হয় জুতার অনলাইন বিক্রয়, যা ধীরে ধীরে বড় পরিসরে প্রসারিত হয়।

প্রথম দিনের চ্যালেঞ্জ ও অনলাইন বিক্রয়

শুরুর দিকে তরিকুল রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডের বিভিন্ন জুতার দোকানে গিয়ে ছবি তুলে ফেসবুকে প্রকাশ করতেন। প্রাথমিকভাবে ৩০টির মতো দোকান থেকে অনুমতি চাইলেও কেবল দুটি দোকান রাজি হয়। প্রথম দিনে বিক্রি হয় মাত্র কয়েক জোড়া জুতা।

ডিজিটাল মার্কেটিং বিশেষজ্ঞ রাশেদুল হাসানের সহযোগিতায় তরিকুলের ওয়েবসাইট এবং ফেসবুক পেজ চালু হয়। এরপর ধীরে ধীরে প্রতিদিনের বিক্রি ১৫ জোড়া পর্যন্ত পৌঁছায়। এই সময়ে তাঁরা নিজেদের ব্র্যান্ডের জন্য নাম নির্ধারণ করেন—‘জুকো’।

তরিকুল ও শাহজাবিন

শাহজাবিন হকেরও বাড়ি পাবনায়। যন্ত্র প্রকৌশলী শহিদুল হক ও গৃহিণী রাবেয়া খাতুনের মেয়ে তিনি। ২০১৬ সালে ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ থেকে পুরকৌশলে বিএসসি ডিগ্রি নিয়ে শাহজাবিন হক যোগ দেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্পে। স্ত্রীর বেতনেই কোনোরকমে কেটে যায় করোনা মহামারির দিনগুলো। সংসারে কোনো অবদান রাখতে না পারায় ক্রমেই হতাশা চেপে ধরে তরিকুলকে।

২০২১ সালে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার দশা হলো এই দম্পতির। শাহজাবিন হকের প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে সে বছরের নভেম্বরে। আবার অন্য প্রকল্পে ঢুকতে হবে। তা–ও কীভাবে কী হবে, পুরোপুরি নিশ্চিত নন। ফলে তিনি তরিকুল ইসলামকে প্রস্তাব দেন দুজন মিলে ব্যবসা শুরু করার। তরিকুলও তো তা–ই ভাবছিলেন। শুধু ভেবে পাচ্ছিলেন না, কী দিয়ে শুরু করবেন। তখনই হুট করে মাথায় এল অনলাইনে জুতার ব্যবসার কথা। স্ত্রীকে তিনি জানান নিজের চিন্তার কথা। শাহজাবিনও রাজি। নিজের জমানো ৯০ হাজার টাকা তুলে দিলেন স্বামীর হাতে। ওই সম্বলটুকু নিয়ে দুজন নেমে পড়লেন ব্যবসায়ে।

তত দিনে তরিকুল যে ই–কমার্স প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন, সেটি আবার চালু হয়েছে। শুরুর দিকে চাকরিটা একদম ছেড়ে না দিয়ে ব্যবসা করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। অফিস শেষ করে রাতে রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে চলে যেতেন। সেখানে গিয়ে একেক দিন একেকটি জুতার দোকানের মালিক ও কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেন। প্রস্তাব দেন, তিনি তাঁদের দোকানের জুতার ছবি তুলে ফেসবুকে দিয়ে বিক্রি করবেন। যদি অর্ডার পান, তাহলে টাকা দিয়ে জুতা কিনে ক্রেতাকে পাঠাবেন। প্রায় ৩০টির মতো দোকানে কথা বলেছিলেন তিনি। এর মধ্যে ২৮টি দোকান থেকে খালি হাতে ফিরে আসতে হয় তাঁকে। দুটি দোকান রাজি হলো। অনুমতি মিলল ছবি তোলার।

নিজেদের কার্যালয়ে তরিকুল ইসলাম ও শাহজাবিন হক (ডানে)

ছবি তুলে তুলে জুতা বিক্রি

তরিকুল ইসলাম তখন ছবি তুলে তুলে ফেসবুকে প্রকাশ করে জুতা বিক্রি করতে থাকেন। শুরুর দিকে দিনে দুই থেকে তিন জোড়া জুতা বিক্রি হওয়া শুরু হলো। সে সময় ডিজিটাল বিপণন নিয়ে কাজ করতেন রাশেদুল হাসান। তাঁর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে পরামর্শ করেন তরিকুল। রাশেদুল তাঁকে জানান, তাঁর ওয়েবসাইট বানানো থেকে শুরু করে সব তিনি ফ্রিতেই করে দেবেন। তবে বিপণনের জন্য যে খরচ, সেটা তরিকুলকেই বহন করতে হবে।

রাশেদুল হাসানের এই প্রস্তাব তরিকুল ইসলামকে আলোড়িত করে। সাহস বাড়িয়ে দেয়। রাশেদুলের ভরসায় তিনি ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেজ চালু করেন। ধীরে ধীরে জুতার নিয়মিত বিক্রিও বাড়ছিল। দুই–তিন জোড়া থেকে প্রতিদিনের জুতা বিক্রি দাঁড়াল ১৫ জোড়ায়। তখনই তরিকুল ইসলামের মাথায় আসে নিজস্ব ব্র্যান্ড বানানোর চিন্তা। তৎক্ষণাৎ একটি নামও ঠিক করেন—জুকো। স্ত্রী শাহজাবিন বাসায় বসে অর্ডার নিতেন, আর তরিকুল ঘুরতেন বাজারে। রাতে বাসায় ফিরে দুজন মিলে প্যাকেজিং করতেন। ধীরে ধীরে বিক্রি আরও বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে চাপও। স্ত্রী শাহজাবিন তখন বলেন, আরও অন্তত দুজন কর্মী প্রয়োজন। তখন বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া দুজন মেয়ে যুক্ত হলেন তাঁদের সঙ্গে। প্যাকেজিংয়ের পাশাপাশি ক্রেতার সঙ্গে কথা বলার কাজ করতেন তাঁরা।

জুকো ব্র্যান্ডের জুতা

নিজের ব্র্যান্ডের প্রতিষ্ঠা

প্রাথমিকভাবে এলিফ্যান্ট রোডের দোকানগুলোর জুতা বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ছিল, তাই নিজের ব্র্যান্ড তৈরি করা অপরিহার্য হয়ে ওঠে। তরিকুল ইসলাম স্থানীয় কারখানার সঙ্গে যোগাযোগ করে নিজস্ব নকশায় জুতা উৎপাদনের ব্যবস্থা করেন। প্রথম ১০ জোড়া জুতা বিজ্ঞাপন ছাড়া ফেসবুকে পোস্ট করা মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যে বিক্রি হয়ে যায়। এর পর নতুন নতুন ডিজাইন ও উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।

২০২২ সালের মার্চে তারা অফিস ও ওয়্যারহাউস নেন। তখন থেকে ক্রমবর্ধমান বিক্রি এবং কর্মীসংখ্যা বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে জুকো ব্র্যান্ডের দুটি শাখা ধানমন্ডি ও বনানী–১০ নম্বরে চালু রয়েছে এবং ৯০ জন কর্মী নিয়োজিত।

ব্যবসার সম্প্রসারণ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

তরিকুল–শাহজাবিন দম্পতি ভবিষ্যতে আরও শাখা খোলার পরিকল্পনা করছেন। তারা চান জুকো ব্র্যান্ডটি বাটা, এপেক্সের মতো বড় ব্র্যান্ডের সঙ্গে সমপর্যায়ে পৌঁছাক। শীঘ্রই বাচ্চাদের, মহিলাদের ও বয়স্কদের জন্য বিভিন্ন ধরনের জুতা বাজারে আনার পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া দেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় শাখা খোলার ইচ্ছাও রয়েছে, যাতে ক্রেতারা সহজেই তাদের জুতা কিনতে পারেন।

প্রভাব ও শিক্ষা

এই গল্পটি দেখায় যে ছোট মূলধন এবং সঠিক পরিকল্পনা দিয়ে কল্পনাযোগ্য সাফল্য অর্জন করা সম্ভব। এছাড়া স্বামী–স্ত্রীর পারস্পরিক সহযোগিতা এবং উদ্যোগের গুরুত্বও স্পষ্ট। তাঁদের গল্প নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য একটি অনুপ্রেরণা, বিশেষ করে যাঁরা অনলাইনে ব্যবসা শুরু করতে চান।

বিশেষজ্ঞ মতামত

অর্থনীতিবিদরা বলেন, তরিকুল–শাহজাবিনের উদ্যোগ বাংলাদেশের ছোট ও মাঝারি উদ্যোগের জন্য একটি প্রেরণাদায়ক দৃষ্টান্ত। এই ধরনের উদ্যোগ দেশের অর্থনীতিতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে এবং ই–কমার্স খাতের প্রসারে ভূমিকা রাখে।

জুকো ব্র্যান্ডের সাফল্য কেবল ব্যবসায়িক মাইলফলক নয়, বরং স্বপ্ন পূরণের এক দৃষ্টান্ত। তরিকুল–শাহজাবিন দম্পতির উদ্যম, কঠোর পরিশ্রম এবং সঠিক পরিকল্পনা প্রমাণ করেছে, সঠিক দিকনির্দেশনা থাকলে স্বল্প মূলধন থেকেও বড় ব্যবসায়িক সাফল্য অর্জন সম্ভব।

এম আর এম – ১৫৭৬,Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button