
বাংলাদেশের মুদ্রাবাজারে ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি মাসে ডলারের দাম কিছুটা কমলেও গত কয়েক দিনে মার্কিন মুদ্রার সরবরাহ বৃদ্ধির মাধ্যমে দাম স্থিতিশীল রাখা হচ্ছে। ব্যাংকগুলো থেকে প্রায় ৪৮ কোটি মার্কিন ডলার কিনে মুদ্রাবাজারে ত্রাণ দিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে এবং বাজারে স্বস্তি ফিরেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ডলার কেনার মাধ্যমে বাজারে স্থিতিশীলতা
বাংলাদেশ ব্যাংকের তরফ থেকে জানানো হয়েছে, মুদ্রাবাজারে ডলারের দাম বাজারভিত্তিক করার পর থেকে দেশের বিভিন্ন ব্যাংক আন্তর্জাতিক চর্চা মেনে নিয়মিত ডলার লেনদেন করছে। ফলে দীর্ঘদিনের মুদ্রাস্ফীতি ও ডলার ঘাটতির পর মুদ্রাবাজারে এক ধরনের স্থিতিশীলতা এসেছে।
বিশেষ করে প্রবাসী কর্মীদের রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় সংগ্রহে ব্যাংকগুলো এখন বেশ সতর্ক ও সংযত নীতিতে কাজ করছে। কম দামে প্রবাসী আয় কেনার মাধ্যমে তারা ডলারের বাজার দমিয়ে রেখেছে। এই কারণে ব্যবসায়ীরা তুলনামূলক কম মূল্যে ডলার পেতে পারছেন। ব্যাংকগুলো থেকে অব্যবহৃত বা উদ্বৃত্ত ডলার নিলামে কিনে বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রাবাজারে দর নিয়ন্ত্রণ করছেন।
আমদানি বিধিনিষেধ প্রত্যাহার ও ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধির আশা
বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মতে, বাজারে ডলারের দাম কমে আসায় আমদানি বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার সময় এসেছে। বর্তমানে বিলাসবহুল পণ্যের আমদানি ও সাধারণ আমদানিতে যেসব বাড়তি শর্ত আরোপ করা হয়েছে, সেগুলোও শিগগির প্রত্যাহার করা উচিত। এতে আমদানি বৃদ্ধি পাবে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি ফিরে আসবে।
তবে গত মঙ্গলবার হঠাৎ ডলারের দাম ১ টাকা ৪০ পয়সা বেড়ে ১২১.৫০ টাকায় উঠেছে, যা গত সোমবারের দামের তুলনায় বেশ কিছুটা বেশি। ব্যাংকগুলো বলছে, এই মূল্য ওঠা-নামা সাময়িক, বাজার ধীরে ধীরে স্থিতিশীল হবে।
চলতি মাসে ডলারের দাম ও লেনদেনের বিস্তারিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গতকাল দেশের মুদ্রাবাজারে ডলার সর্বোচ্চ ১২১ টাকা ৫০ পয়সায় বিক্রি হয়েছে এবং সর্বনিম্ন ১২০ টাকা ৮০ পয়সায় কেনা হয়েছে। গত সোমবার ডলারের দাম ছিল যথাক্রমে বিক্রি ১২০.১০ টাকা ও ক্রয় ১১৯.৫০ টাকা। গড় বিক্রয়মূল্য ছিল ১২১.১১ টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংক গতকাল নিলামে ৩১ কোটি ৩০ লাখ ডলার কেনে, যা ২২টি ব্যাংক থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রতি ডলার কেনার দাম ছিল ১২১.৫০ টাকা। এর আগে গত রোববার বাংলাদেশ ব্যাংক একই পদ্ধতিতে ১৭ কোটি ১০ লাখ ডলার কিনেছিল।
ডলারের চাহিদা ও প্রবাসী আয় বৃদ্ধি
একজন উচ্চ পদস্থ ব্যাংক কর্মকর্তা জানান, দেশে আমদানি বকেয়া পরিশোধ শেষ হওয়ায় ডলারের চাহিদা কিছুটা কমেছে। অন্যদিকে প্রবাসী আয় ও রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ বেড়েছে। এসব কারণে ডলারের সংকট কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে দেশ।
এর ফলে আমদানিতে স্বস্তি দেখা দিয়েছে। তবে ব্যবসায়ীদের মধ্যে এখনও কিছুটা সতর্কতা রয়েছে, বিশেষ করে ঋণপত্র খোলার হার কম থাকায় আমদানি প্রবাহে স্থবিরতা রয়েছে। ব্যাংকগুলোতেও ডলারের চাহিদা এখন কম।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ডলারের দাম কমানোর গুরুত্ব
বাংলাদেশে প্রায় তিন বছর ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ সাধারণ মানুষের জীবনে বিশাল প্রভাব ফেলেছে। এর পেছনে ডলারের উচ্চ দাম অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখযোগ্য। ডলারের দাম কমলে দেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হয়। অন্তর্বর্তী সরকারের লক্ষ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা।
বর্তমানে ডলারের দাম কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতে স্বাভাবিক পর্যায়ে রয়েছে এবং এটি বজায় রাখতে বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। ব্যাংকগুলো এখন প্রবাসী আয়ের ডলার ১২১ টাকায় কিনছে, যা এক মাস আগের তুলনায় কম। এর ফলে ডলারের বাজারে চাপ কমছে এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়তা মিলছে।
ভবিষ্যৎ ও সুপারিশ
বিশ্লেষকরা মনে করেন, দেশের অর্থনীতির সুষ্ঠু প্রবাহ ও ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নয়নে ডলারের মূল্য স্থিতিশীল রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আগামী সময়ে আমদানি বিধিনিষেধ শিথিল করা হলে ব্যবসায়িক গতি বৃদ্ধি পাবে। এতে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় আরও বাড়বে, যা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সুরক্ষিত রাখতে সহায়তা করবে।
অন্যদিকে, মুদ্রাবাজারের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরও কিছু সময় বাজার পর্যবেক্ষণ ও প্রয়োজনে নিলাম পদ্ধতির মাধ্যমে ডলার কেনা ও বিক্রি চালিয়ে যেতে হবে।
সংক্ষিপ্ত সারাংশ
- বাংলাদেশ ব্যাংক গত দুই দিনে ৪৮ কোটি ডলার ব্যাংক থেকে কিনেছে।
- ডলারের সরবরাহ বৃদ্ধির ফলে মুদ্রাবাজারে দাম কমেছে, কিছুটা স্থিতিশীলতা এসেছে।
- আমদানি বিধিনিষেধ শিথিল করতে ব্যাংক কর্মকর্তারা সুপারিশ করেছেন।
- চলতি মাসে ডলারের দাম কিছু ওঠানামা করেছে, তবে গড় মূল্য কমেছে।
- প্রবাসী আয় ও রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পেয়েছে, ডলারের সংকট কাটছে।
- উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ডলারের দাম কমানো গুরুত্বপূর্ণ।
- ভবিষ্যতে আমদানি বাড়াতে শর্ত শিথিল ও বাজারে ডলারের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা প্রয়োজন।