স্বাস্থ্য

অক্টোবরের আগেই ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়ংকর পর্যায়ে

Advertisement

ঢাকাসহ সারাদেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ক্রমেই ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসের ২৬ দিনের মধ্যে দেশে ১৩ হাজারের বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, এবং ৬৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, আগামী অক্টোবর মাসে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও মারাত্মক হতে পারে।

রাজধানীতে ডেঙ্গু পরিস্থিতি এখন চরম

রাজধানী ঢাকা শহরের হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীর চাপ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিশেষ করে ঢাকা ন্যাশনাল হাসপাতাল (ডিএনসিসি)-এ বর্তমানে বছরের মধ্যে সর্বাধিক রোগী ভর্তি রয়েছেন। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে রোগীরা এখানে চিকিৎসার জন্য আসছেন।

ডিএনসিসি হাসপাতালের জুনিয়র কনসালটেন্ট ডা. সোহেল আসকার জানিয়েছেন, “প্রতি বছর ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়, কিন্তু চলতি বছর পরিস্থিতি আগে কখনো দেখেনি এমন। এই মুহূর্তে আমাদের হাসপাতালে বিগত বছরের তুলনায় সবচেয়ে বেশি রোগী ভর্তি রয়েছে। গরমের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি-ঘরের আশপাশে পানি জমে থাকছে। আগামী এক মাসও যদি এমন থাকে, ডেঙ্গু রোগী সংখ্যা আরও বাড়বে।”

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য

স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ সপ্তাহে প্রায় ৩,৫০০ মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। শুধু আক্রান্ত নয়, মৃত্যুও কমছে না। চলতি মাসে মৃত্যু সংখ্যা গত মাসের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।

ডা. সোহেল আরও জানিয়েছেন, “ডেঙ্গু রোগীর জন্য প্রাথমিক দুই থেকে তিন ঘণ্টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জটিল পরিস্থিতিতে রোগীকে প্রথমে নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে আসা উচিত। প্রয়োজন হলে হাসপাতালের পরামর্শে অন্যত্র স্থানান্তর করা যেতে পারে। তবে রোগী নিজেই দূর থেকে ঢাকায় আসার চেষ্টা করলে বিপদ বাড়তে পারে। অনেক রোগী এই ভুল করছেন।”

সারাদেশে মশার উৎপাত বৃদ্ধি

ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়লেও দেশে মশা নিধনের কার্যক্রম এখনও পর্যাপ্ত নয়। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এডিস মশার ঘনত্ব বৃদ্ধি ও উপযুক্ত আবহাওয়ার কারণে ডেঙ্গুর ঝুঁকি আরও বেড়ে গেছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার বলেন, “বর্তমানে এডিস মশার ঘনত্ব ডেঙ্গু ছড়ানোর জন্য উপযুক্ত। এই সময়ে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান একইসঙ্গে উপস্থিত:
১. সংক্রামিত রোগী
২. উচ্চ ঘনত্বের এডিস মশা
৩. রোগ বিস্তার উপযোগী পরিবেশ।

এই ‘এপিডেমিওলজিক্যাল ট্রায়াঙ্গেল’ অনুযায়ী, অক্টোবর মাসে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে।”

দেশের চিকিৎসা অবস্থা

স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে বর্তমানে দুই হাজারের বেশি রোগী ডেঙ্গু চিকিৎসা নিচ্ছেন। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে জানিয়েছেন, আক্রান্ত রোগীর দ্রুত প্রাথমিক চিকিৎসা এবং সময়মতো হাসপাতালে ভর্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ঢাকা শহরের হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর চাপ বৃদ্ধির পেছনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে:

  • বৃষ্টিপাতের পানি জমে থাকা
  • বাসা ও আশপাশের বর্জ্য ও জলাবদ্ধতা
  • মশা নিধনের কার্যক্রম অপর্যাপ্ত
  • রোগীর চিকিৎসা নিয়ে সচেতনতার অভাব

ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধে সাধারণ মানুষকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জল জমে থাকা স্থান পরিস্কার করা, মশা দমনের স্প্রে ব্যবহার, এবং রাতের বেলায় মশারি ব্যবহার খুবই জরুরি।

কীভাবে ডেঙ্গু ছড়ায়

ডেঙ্গু হলো এডিস মশা দ্বারা ছড়ানো ভাইরাল রোগ, যা সাধারণত দিনে কামড় দেয়। ডেঙ্গুর লক্ষণগুলো হলো:

  • হঠাৎ জ্বর
  • মাথা ব্যথা
  • চোখের পেছনে ব্যথা
  • মাংসপেশিতে ব্যথা
  • ত্বকে লাল দাগ

কিছু ক্ষেত্রে রোগীকে হেমোরেজিক ডেঙ্গু বা ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোম হতে পারে, যা প্রাণঘাতী। তাই প্রাথমিক চিকিৎসা নিলে মৃত্যুর ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব।

ডেঙ্গু প্রতিরোধে সরকারের পদক্ষেপ

সরকার এবং স্বাস্থ্য বিভাগ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যেমন:

  • ডেঙ্গু রোগী শনাক্তকরণ ও রিপোর্টিং বৃদ্ধি
  • হাসপাতালগুলোর চিকিৎসা ক্ষমতা বৃদ্ধি
  • সচেতনতামূলক প্রচারণা

তবে, দেশের বিভিন্ন এলাকায় মশা নিধনের কাজ এখনও পর্যাপ্ত নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি জনগণকে নিজস্ব সতর্কতাও নিতে হবে।

সামগ্রিক পরিস্থিতির পূর্বাভাস

বিশেষজ্ঞদের মতে, অক্টোবর মাসের শুরুতে গরম এবং আর্দ্র আবহাওয়ার কারণে ডেঙ্গুর সংক্রমণ তীব্র হতে পারে। “এডিস মশার ঘনত্ব ও রোগীর সংখ্যা যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে আগামী মাসে হাসপাতালে রোগীর চাপ এবং মৃত্যু হার আরও বাড়তে পারে। তাই এখনই সচেতন হওয়ার সময়,” বলছেন ড. কবিরুল বাশার।

ডেঙ্গুর প্রকোপ ঠেকাতে সরকার এবং স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সাধারণ মানুষকে নিম্নলিখিত পরামর্শ দিচ্ছেন:

  1. বাড়ির আশেপাশের জল জমে থাকা জায়গা পরিস্কার করুন
  2. পানি ভরা বাসন, টায়ার বা পাত্রে মশা জন্মাবার সম্ভাবনা থাকলে নিয়মিত ঢেকে রাখুন
  3. রাতে মশারি ও রেপেলেন্ট ব্যবহার করুন
  4. জ্বর ও অন্যান্য উপসর্গ দেখা দিলে তারাতারি নিকটস্থ হাসপাতালে চিকিৎসা নিন

ডেঙ্গু প্রতিরোধে সরকারি প্রচেষ্টা এবং জনগণের সচেতনতা মিলিতভাবে কার্যকর হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। তবে, অক্টোবরে যদি প্রাকৃতিক পরিবেশ ও আবহাওয়া অনুকূল না থাকে, ডেঙ্গুর প্রকোপ আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।


২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরেই ডেঙ্গুর সংক্রমণ গত বছরের তুলনায় বহুগুণ বেড়েছে। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা এবং মৃত্যুর হার বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, অক্টোবর মাসে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে। তাই সাধারণ মানুষকে সতর্ক হওয়া এবং প্রাথমিক প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি।

সারাদেশের হাসপাতাল, স্বাস্থ্য বিভাগ ও কীটতত্ত্ববিদদের সতর্কবার্তা: ডেঙ্গু মোকাবিলায় সময়মতো ব্যবস্থা না নিলে এবং সচেতনতা না বাড়ালে আগামী মাসে আরও বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।

MAH – 13035 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button