জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনে শুক্রবার এক আবেগঘন ও উত্তেজিত বক্তৃতায় ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু অভিযোগ করেছেন, “ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমে ইউরোপীয় দেশগুলো আসলে ইসরায়েলকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।”
নেতানিয়াহু বলেন, “যারা ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, তারা মূলত ইসরায়েলের গলায় ছুরি ধরেছে। এটি আমাদের রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে ঝুঁকির মুখে ফেলবে। আপনারা আসলে ইহুদি হত্যাকে বৈধতা দিচ্ছেন।”
তার এ মন্তব্যে জাতিসংঘ অধিবেশন কক্ষে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। অনেকে করতালির মাধ্যমে নেতানিয়াহুর বক্তব্যকে সমর্থন জানান, আবার অনেক প্রতিনিধি দৃশ্যত বিরক্ত হয়ে মাথা নেড়ে অসম্মতি প্রকাশ করেন।
ইসরায়েলের আশঙ্কা: ‘সন্ত্রাসী রাষ্ট্রের জন্ম’
নেতানিয়াহু তার বক্তৃতায় সরাসরি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন—
“ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করলে সেটি হবে একটি সন্ত্রাসী রাষ্ট্র। সেই রাষ্ট্র আমাদের গলায় ছুরি ধরে থাকবে। আর আমরা কখনোই সেই পরিস্থিতি মেনে নেব না।”
তার মতে, হামাস, ইসলামিক জিহাদসহ বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন ফিলিস্তিনের অংশ হয়ে উঠলে ইসরায়েলের জনগণের নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। এজন্য তিনি বিশ্ব নেতাদের আহ্বান জানান, যেন “অভিযোগ শোনার আগে বাস্তবতা বোঝেন।”
ইউরোপের পাল্টা অবস্থান
গত কয়েক মাসে স্পেন, আয়ারল্যান্ড, নরওয়ে, স্লোভেনিয়া, মাল্টা ও ফ্রান্সসহ বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
তাদের যুক্তি হলো— ১৯৬৭ সালের সীমানার ভিত্তিতে দুই রাষ্ট্র সমাধান ছাড়া স্থায়ী শান্তি সম্ভব নয়।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের কূটনৈতিক দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, “ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমে আমরা শান্তির পথে একটি বার্তা দিয়েছি। এর মানে এই নয় যে, আমরা ইসরায়েলের নিরাপত্তাকে অগ্রাহ্য করছি। বরং দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের জন্যই এই পদক্ষেপ।”
ফিলিস্তিনের প্রতিক্রিয়া: ‘একজন পরাজিত মানুষের জবানবন্দি’
পশ্চিম তীরের রামাল্লায় অবস্থিত ফিলিস্তিনি সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আদেল আতিয়েহ নেতানিয়াহুর বক্তব্যকে ‘হতাশাজনক ও বাস্তবতা-বিবর্জিত’ বলে অভিহিত করেন।
তিনি বলেন,
“জাতিসংঘে নেতানিয়াহুর বক্তৃতা মূলত একজন পরাজিত মানুষের জবানবন্দি। তিনি আন্তর্জাতিক সমাজের ইচ্ছাকে সম্মান করতে ব্যর্থ হয়েছেন। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ যখন দুই রাষ্ট্র সমাধানের পক্ষে, তখন ইসরায়েল এককভাবে যুদ্ধের পথে হাঁটছে।”
জাতিসংঘে পরিবেশ ও কূটনৈতিক বিশ্লেষণ
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে এবারের অধিবেশনে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন প্রশ্নটি ছিল অন্যতম আলোচিত বিষয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জার্মানিসহ কয়েকটি দেশ প্রকাশ্যে ইসরায়েলের নিরাপত্তার প্রতি সমর্থন জানালেও, অধিকাংশ উন্নয়নশীল ও মুসলিম রাষ্ট্র ফিলিস্তিনকে পূর্ণ রাষ্ট্র স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি তুলেছে।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে,
- ইউরোপীয় দেশগুলোর এই স্বীকৃতি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ইসরায়েলের কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতা আরও স্পষ্ট করে তুলছে।
- অন্যদিকে, আরব লীগ ও ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি) একযোগে এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বলেছে, “এটি ফিলিস্তিনি জনগণের দীর্ঘ দিনের সংগ্রামের একটি মাইলফলক।”
যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। তবে হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এক বিবৃতিতে বলেছেন,
“আমরা দুই রাষ্ট্র সমাধানের পক্ষে। তবে সেটি আলোচনার মাধ্যমেই হতে হবে, একতরফা সিদ্ধান্তের মাধ্যমে নয়।”
এ মন্তব্যকে অনেক বিশেষজ্ঞ ‘কূটনৈতিক ভারসাম্য’ রক্ষার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখছেন।
ইতিহাসের প্রেক্ষাপট
১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ফিলিস্তিন প্রশ্ন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অন্যতম জটিল ইস্যু।
- ১৯৬7 সালের ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরায়েল পশ্চিম তীর, গাজা উপত্যকা ও পূর্ব জেরুজালেম দখল করে নেয়।
- সেই থেকেই আন্তর্জাতিক মহল “দুই রাষ্ট্র সমাধান”— অর্থাৎ ইসরায়েলের পাশাপাশি একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলছে।
তবে ইসরায়েল বারবার নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগের কথা বলে ফিলিস্তিনকে পূর্ণ রাষ্ট্র স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মত
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন বলেছে,
“ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি না দিলে মধ্যপ্রাচ্যে সহিংসতা কখনো শেষ হবে না। নেতানিয়াহুর বক্তব্য শান্তির পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে।”
বিশ্লেষণ: শান্তি নাকি নতুন সংঘাত?
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ইউরোপীয় দেশগুলোর স্বীকৃতি একদিকে ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য আশার আলো হলেও, অন্যদিকে ইসরায়েলের সঙ্গে উত্তেজনা আরও বাড়াতে পারে।
মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক গবেষকরা বলছেন,
- যদি ইসরায়েল আরও কঠোর অবস্থান নেয়, তবে নতুন করে সশস্ত্র সংঘাত শুরু হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
- আবার কূটনৈতিক চাপে ইসরায়েলকে আলোচনার টেবিলে ফিরতেও বাধ্য করা হতে পারে।
জাতিসংঘের মঞ্চে নেতানিয়াহুর এ বক্তৃতা স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, ফিলিস্তিন প্রশ্নে ইসরায়েল ও আন্তর্জাতিক সমাজের মধ্যে গভীর বিভাজন বিদ্যমান।
একদিকে যখন ইউরোপীয় ও আরব দেশগুলো ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়ে সমাধানের পথ খুঁজছে, তখন ইসরায়েল সেটিকে “আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত” বলে প্রত্যাখ্যান করছে।
এ অবস্থায় মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা আরও জটিল হয়ে উঠছে। বিশ্বের চোখ এখন ওয়াশিংটন ও ব্রাসেলসের দিকে— যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ আসলে কোন পথে হাঁটবে, সেটিই ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দেবে।
MAH – 13029 I Signalbd.com



