চলতি বছরে মোট প্রাণহানি ১৮৮, আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়াল ৪৪ হাজার
বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দিন দিন উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। বৃহস্পতিবার (২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫) স্বাস্থ্য অধিদফতরের সর্বশেষ প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় এডিস মশাবাহিত এই রোগে আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে নতুন করে ৬৩২ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
কোথায় কতজন ভর্তি
প্রতিবেদনে বলা হয়, বুধবার সকাল ৮টা থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বিভাগে নতুন রোগী ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে—
- ঢাকা মহানগরীর হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হয়েছেন ২০৭ জন
- ঢাকা বিভাগের জেলাগুলোতে ১০১ জন
- বরিশাল বিভাগে ১৫৭ জন
- চট্টগ্রাম বিভাগে ৭৮ জন
- রাজশাহী বিভাগে ৫৬ জন
- খুলনা বিভাগে ৩৩ জন
এই পরিসংখ্যান থেকেই বোঝা যায়, রাজধানী ঢাকা ও বরিশাল অঞ্চলে ডেঙ্গুর সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি।
চলতি বছরের পরিস্থিতি
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১৮৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ৯৬ জন পুরুষ ও ৯২ জন নারী। এছাড়া ৪৪ হাজার ৪৭৩ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
এর আগে, গত রোববার একদিনে ১২ জনের মৃত্যু হয়, যা চলতি বছরে এক দিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু।
ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব কেন বাড়ছে?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কয়েকটি কারণে এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে—
- অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত ও জলাবদ্ধতা – শহরের ড্রেনেজ ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে সামান্য বৃষ্টিতেই পানি জমে থাকে। এতে এডিস মশার প্রজনন বাড়ছে।
- অসচেতনতা – অনেকেই বাসা-বাড়ির ফুলের টব, ছাদের পানি, এসির ট্রে বা পরিত্যক্ত টায়ারে জমে থাকা পানির দিকে নজর দেন না।
- শহর পরিকল্পনায় দুর্বলতা – ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় নিয়মিত মশা নিধন কার্যক্রম না থাকায় এডিস মশার বিস্তার ঘটছে।
- জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব – আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারণে এডিস মশার প্রজননের সময় বেড়ে যাচ্ছে।
ডেঙ্গুর উপসর্গ
ডেঙ্গু সাধারণত চার থেকে সাত দিনের মধ্যে প্রকাশ পায়। সাধারণ লক্ষণগুলো হলো—
- হঠাৎ করে উচ্চ জ্বর
- প্রচণ্ড মাথাব্যথা
- চোখের পিছনে ব্যথা
- শরীর ও জয়েন্টে ব্যথা
- বমি বমি ভাব বা বমি
- ত্বকে লালচে দাগ বা র্যাশ
গুরুতর ক্ষেত্রে নাক-মুখ দিয়ে রক্তক্ষরণ, শ্বাসকষ্ট ও অঙ্গ বিকল হওয়ার মতো জটিলতা দেখা দিতে পারে।
কীভাবে প্রতিরোধ করা যায়?
ডেঙ্গু প্রতিরোধে বিশেষজ্ঞরা কয়েকটি পরামর্শ দিয়েছেন—
- যে কোনো স্থানে পানি জমতে দেওয়া যাবে না
- সপ্তাহে অন্তত একবার বাড়ির আশেপাশে টব, ড্রাম, বোতল ইত্যাদি ফেলে দিতে হবে বা পরিষ্কার করতে হবে
- ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার করতে হবে
- সকাল-বিকেলে মশা নিধন স্প্রে ব্যবহার করা উচিত
- বাচ্চাদের স্কুলে হাফপ্যান্ট বা ছোট জামার পরিবর্তে ফুল স্লিভ ও ফুল প্যান্ট পরানো ভালো
- শরীরে জ্বর হলে অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে
সরকার ও সিটি করপোরেশনের উদ্যোগ
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন জানিয়েছে, প্রতিদিন নির্দিষ্ট এলাকায় মশা নিধন ওষুধ ছিটানো হচ্ছে। এছাড়া জনগণকে সচেতন করতে প্রচারণা বাড়ানো হয়েছে। তবে নগরবাসীর অভিযোগ, অনেক জায়গায় কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক বলেছেন, “ডেঙ্গু মোকাবিলায় সরকার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। তবে জনসচেতনতাই সবচেয়ে বড় হাতিয়ার।”
বিশ্বে ডেঙ্গুর প্রভাব
শুধু বাংলাদেশ নয়, দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশেও ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে।
- ভারতে চলতি বছর আগস্ট-সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা রেকর্ড ছাড়িয়েছে।
- ফিলিপাইনসে এক মাসেই ২০ হাজারের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে।
- শ্রীলঙ্কা ও নেপালেও একই অবস্থা বিরাজ করছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) সতর্ক করেছে, জলবায়ু পরিবর্তন ও নগরায়নের কারণে আগামী বছরগুলোতে এশিয়া ও আফ্রিকার আরও বেশি দেশে ডেঙ্গুর ঝুঁকি বাড়বে।
সমাধান কী?
ডেঙ্গু পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব না হলেও কার্যকর পদক্ষেপ নিলে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। যেমন—
- শহরে কার্যকর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা
- নিয়মিত মশা নিধন কর্মসূচি
- স্কুল-কলেজ ও অফিসে সচেতনতা কার্যক্রম
- নাগরিকদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ
ডেঙ্গু এখন কেবল স্বাস্থ্য সমস্যা নয়, এটি জাতীয় সংকটে রূপ নিয়েছে। প্রতিদিন মৃত্যুর খবর আতঙ্ক বাড়াচ্ছে। তাই সরকার, সিটি করপোরেশন ও জনগণ—সবাইকে একসাথে কাজ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, সামান্য অসচেতনতা একটি পরিবারের জীবন কেড়ে নিতে পারে।
MAH – 13013 I Signalbd.com



