একসময় ডায়াবেটিসকে শুধুই মধ্যবয়সী কিংবা বয়স্কদের রোগ মনে করা হতো। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে তরুণ-তরুণীদের মাঝেও ডায়াবেটিস দ্রুত বাড়ছে। অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন, স্থূলতা এবং মানসিক চাপ এই প্রবণতাকে আরও ত্বরান্বিত করছে।
তরুণদের মধ্যে ডায়াবেটিস বাড়ছে কেন
বিশেষজ্ঞদের মতে, তরুণ প্রজন্মের ডায়াবেটিসের প্রধান কারণ হলো অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস ও স্থূলতা। আধুনিক জীবনযাত্রায় ফাস্ট ফুড, সফট ড্রিংকস, চিপস, বার্গার কিংবা জাঙ্ক ফুডের প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরতা শরীরের ওজন দ্রুত বাড়ায়। একই সঙ্গে কায়িক পরিশ্রম কমে যাওয়ায় ইনসুলিনের কার্যক্ষমতা হ্রাস পায়।
টাইপ ওয়ান বনাম টাইপ টু ডায়াবেটিস
ডায়াবেটিসের মূলত দুটি ধরন তরুণদের মধ্যে দেখা যায়।
- টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিস: শিশু বা কিশোর বয়সে বেশি হয়। এ ক্ষেত্রে অগ্ন্যাশয় পর্যাপ্ত ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না।
- টাইপ টু ডায়াবেটিস: আগে মূলত বয়স্কদের মধ্যে দেখা যেত, তবে বর্তমানে তরুণদের মধ্যেও আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। এর মূল কারণ হলো স্থূলতা, অনিয়মিত জীবনযাপন এবং ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স।
পারিবারিক ও জিনগত প্রভাব
যাদের পরিবারে আগে থেকেই ডায়াবেটিস আছে, তাদের ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে বেশি। বিশেষ করে বাবা-মায়ের যেকোনো একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলে সন্তানের ঝুঁকি দ্বিগুণ হয়ে যায়। এছাড়া এমওডিআই (MODY) নামের জিনগত ডায়াবেটিস ২৫ বছরের আগেই দেখা দিতে পারে।
জীবনযাত্রার পরিবর্তন ও ঝুঁকি
প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক জীবনযাত্রা তরুণদের শারীরিক কার্যক্রম কমিয়ে দিয়েছে। দীর্ঘ সময় মোবাইল, ল্যাপটপ বা টিভির সামনে বসে থাকা, অনিয়মিত ঘুম, মানসিক চাপ এবং বিষণ্নতা ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। বিশেষ করে যারা স্থূলতার পাশাপাশি উচ্চ রক্তচাপ, হরমোনের সমস্যা বা ডিম্বাশয়ে সিস্টে ভুগছে, তারা বেশি ঝুঁকিতে থাকে।
পরিসংখ্যান কী বলছে
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় প্রতি ২৫ জন তরুণের মধ্যে একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। তাদের দুই-তৃতীয়াংশ জানেই না যে তারা এ রোগ বহন করছে। তরুণদের ডায়াবেটিসের হার বর্তমানে প্রায় ৪ দশমিক ২ শতাংশ, যা স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের কাছে এক বড় অশনিসংকেত।
লক্ষণ ও প্রাথমিক সতর্কতা
তরুণদের ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে অনেক সময় কোনো সুস্পষ্ট লক্ষণ দেখা যায় না। তবে সাধারণত ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া, অতিরিক্ত তৃষ্ণা, অস্বাভাবিকভাবে ক্লান্তি, ক্ষত শুকাতে দেরি হওয়া, ঘুমে অস্থিরতা এবং অকারণ ওজন কমে যাওয়া—এসবই হতে পারে প্রাথমিক সংকেত। মেয়েদের ক্ষেত্রে অনিয়মিত মাসিক বা গর্ভপাতের ঝুঁকি বাড়তেও পারে।
প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের উপায়
তরুণদের ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সচেতনতা।
- সুষম খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখা
- নিয়মিত ব্যায়াম (প্রতিদিন অন্তত ৩০–৪৫ মিনিট হাঁটা বা শারীরিক কসরত)
- পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করা
- মানসিক চাপ কমানো
- ফাস্ট ফুড ও মিষ্টি পানীয় কমিয়ে দেওয়া
- প্রতি তিন মাস অন্তর রক্তের সুগার পরীক্ষা করা
বিশেষজ্ঞদের মতামত
ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তরুণদের জন্য ডায়াবেটিস শুধুই একটি স্বাস্থ্যঝুঁকি নয়; বরং দীর্ঘমেয়াদে এটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকট তৈরি করতে পারে। একজন বিশেষজ্ঞ মন্তব্য করেছেন:
“তরুণরা যদি এখন থেকেই জীবনযাত্রায় পরিবর্তন না আনে, তাহলে ভবিষ্যতে ডায়াবেটিসের বোঝা পুরো সমাজকেই বহন করতে হবে।”
তরুণ-তরুণীদের ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা এখন আর ব্যতিক্রম নয়, বরং এক ভয়াবহ বাস্তবতা। যাদের হাত ধরে আগামী দিনের বাংলাদেশ গড়ে উঠবে, তাদেরই যদি কম বয়সে দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্ত হতে হয়, তাহলে তা দেশের জন্যও বিপজ্জনক। তাই এখন থেকেই প্রয়োজন সচেতনতা, জীবনযাত্রার পরিবর্তন এবং নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষা।
এম আর এম – ১৫০০,Signalbd.com



