জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন শুরুর আগমুহূর্তে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে আরও ছয়টি ইউরোপীয় দেশ। এর মধ্যে রয়েছে ফ্রান্স, বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ, মাল্টা, সান মারিনো ও অ্যান্ডোরা। এ সিদ্ধান্তকে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে এক ঐতিহাসিক বাঁক হিসেবে দেখা হচ্ছে। তবে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র এই পদক্ষেপের তীব্র বিরোধিতা করেছে।
সম্মেলন ও নতুন স্বীকৃতির ঘোষণা
নিউইয়র্কে ফ্রান্স ও সৌদি আরবের আয়োজনে সোমবার স্থানীয় সময় বিকেল ৩টায় শুরু হচ্ছে বিশেষ আন্তর্জাতিক সম্মেলন। এই সম্মেলনের মঞ্চ থেকেই ফিলিস্তিনকে নতুন ছয় দেশ আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। মাত্র একদিন আগে যুক্তরাজ্য, কানাডা, পর্তুগাল ও অস্ট্রেলিয়া ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ফলে গত ২৪ ঘণ্টায় ১০টিরও বেশি দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিল।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ এই উদ্যোগে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তার মতে, “দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান ছাড়া দীর্ঘস্থায়ী শান্তি সম্ভব নয়, তাই এখনই সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।”
ফিলিস্তিন রাষ্ট্র স্বীকৃতির আন্দোলন
ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি বহু দশকের পুরনো। ইতোমধ্যে বিশ্বের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ দেশ ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে পশ্চিমা বড় দেশগুলোর অবস্থান নিয়ে সবসময়ই ছিল অনিশ্চয়তা।
১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে সংঘাত শুরু হয়। জাতিসংঘের বেশ কয়েকটি প্রস্তাবে দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের কথা বলা হলেও বাস্তবে তা কার্যকর হয়নি। গত দুই বছরে গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের কারণে এই স্বীকৃতির দাবি আরও জোরদার হয়েছে।
ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের কড়া অবস্থান
নতুন স্বীকৃতির ঘোষণায় সবচেয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ইসরায়েল। দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু একে “সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য” বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, নিউইয়র্ক সফর শেষে দেশে ফিরে এর জবাব দেওয়া হবে।
ইসরায়েলের জাতিসংঘ প্রতিনিধি ড্যানি দানন এই সম্মেলনকে “সার্কাস” আখ্যা দিয়েছেন। তার দাবি, “এটি সন্ত্রাসবাদকে পুরস্কৃত করার মতো সিদ্ধান্ত।” অন্যদিকে, ইসরায়েলের কয়েকজন মন্ত্রী পশ্চিম তীরের কিছু অংশ দখল করার দাবি তুলেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রও এ সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে। হোয়াইট হাউস এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, “আমাদের মূল লক্ষ্য হলো ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, জিম্মিদের মুক্তি এবং হামাসমুক্ত শান্তি প্রতিষ্ঠা। এ ধরনের ঘোষণায় সমস্যার সমাধান নয়, বরং জটিলতা বাড়বে।”
আরব বিশ্বের প্রতিক্রিয়া
সৌদি আরব নতুন স্বীকৃতির ঘোষণাকে স্বাগত জানালেও ইসরায়েলকে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছে। রিয়াদ জানিয়েছে, পশ্চিম তীর দখলের চেষ্টা হলে এর ভয়াবহ পরিণতি হবে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতও স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছে, ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে অস্বীকার করা তাদের জন্য “রেড লাইন”। মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশও এ পদক্ষেপকে শান্তির পথে ইতিবাচক অগ্রগতি হিসেবে দেখছে।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রতিক্রিয়া ও বিশ্লেষণ
বিশেষজ্ঞদের মতে, পশ্চিমা কয়েকটি বড় দেশের এই সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটি শক্ত বার্তা পাঠাবে। দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক কূটনৈতিক সমীকরণে ফিলিস্তিন প্রশ্ন উপেক্ষিত থাকলেও, ইউরোপীয় দেশগুলো নতুন করে উদ্যোগ নিচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, একের পর এক পশ্চিমা দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিলে ইসরায়েলের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়বে। তবে ইসরায়েলের কড়া অবস্থান ও যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন থাকায় তাৎক্ষণিক পরিবর্তন আসবে না।
ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি কী হতে পারে?
নতুন স্বীকৃতির ফলে ফিলিস্তিন আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে আরও গ্রহণযোগ্যতা পাবে। তবে বাস্তবে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিনকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে আরও দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে। ইসরায়েলের দখলকৃত অঞ্চল ও চলমান সংঘাতের কারণে সেই পথ সহজ নয়।
তবে পর্যবেক্ষকরা বলছেন, যদি আরও বড় পশ্চিমা শক্তিগুলো ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়, তাহলে শান্তি প্রক্রিয়া নতুন গতি পেতে পারে। এখন প্রশ্ন হলো, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের বিরোধিতা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কি একত্রিত হয়ে ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি বাস্তবায়নে এগোতে পারবে?
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন শুরুর আগে ফিলিস্তিনকে ছয় ইউরোপীয় দেশের স্বীকৃতি মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এটি একদিকে ফিলিস্তিনের জন্য নতুন কূটনৈতিক শক্তি এনে দিয়েছে, অন্যদিকে ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্রকে চাপে ফেলেছে। তবে চূড়ান্ত সমাধান কতটা সম্ভব হবে, তা নির্ভর করছে পরবর্তী আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ার ওপর।
এম আর এম – ১৪৬০,Signalbd.com



