স্বাস্থ্য

নিজের সব সম্পদ স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে বিলিয়ে দেবেন বিল গেটস

Advertisement

বিশ্বখ্যাত প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ও দাতব্য কাজের প্রবক্তা বিল গেটস আবারও স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগের গুরুত্বের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তিনি স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক দুই দশকে শিশু মৃত্যুহার অর্ধেকে কমে আসা মানবজাতির এক অসাধারণ অর্জন। তবে তিনি সতর্ক করে বলেছেন, যদি এই অগ্রগতি রক্ষার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তা আবারো পিছিয়ে যেতে পারে।

২০০০ সালের দিকে, বিশ্বব্যাপী প্রায় এক কোটি শিশু পাঁচ বছর বয়সে পৌঁছানোর আগেই মারা যেত। কিন্তু বর্তমানে এই সংখ্যা কমে এসেছে অর্ধেকে, প্রায় ৫০ লাখে। অর্থাৎ, ২৫ বছরের মধ্যে শিশু মৃত্যুহার অর্ধেক কমে এসেছে। বিল গেটস একে মানবজাতির ‘অভূতপূর্ব সাফল্য’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

টাইম ম্যাগাজিনের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, “এখনও বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি শিশুর জীবন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ধনী দেশগুলো যদি স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বৃদ্ধি না করে, তাহলে ভবিষ্যতে শিশুদের জীবন বিপন্ন হতে পারে। তবে যদি আমরা বর্তমান বিনিয়োগ বজায় রাখি, আগামী ২০ বছরে শিশু মৃত্যুহার আরও অর্ধেক কমানো সম্ভব।”

নতুন প্রযুক্তি ও চিকিৎসা উদ্ভাবনে আশা

বিল গেটস বিশ্ব স্বাস্থ্য খাতে গবেষণা ও নতুন প্রযুক্তির গুরুত্বও তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে নতুন প্রযুক্তি প্রায় রোগটিকে নির্মূল করতে সক্ষম। নবজাতকের শ্বাসকষ্ট রোধে মাতৃ-টিকা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এছাড়া এইচআইভি চিকিৎসায় নতুন ওষুধের উদ্ভাবন দৈনন্দিন বড়ি খাওয়ার ঝামেলা দূর করবে।

তার মতে, সঠিক বিনিয়োগ এবং পরিকল্পনা হলে একদিন এইচআইভি/এইডসকে ‘অতীতের রোগ’ হিসেবে দেখা সম্ভব।

দরিদ্র দেশ ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা

গেটস উল্লেখ করেছেন, দরিদ্র দেশগুলিতে স্বাস্থ্যনীতি কার্যকর করতে গ্লোবাল ফান্ড ও গাভি (GAVI) মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। কেবলমাত্র গ্লোবাল ফান্ডই ২০০২ সাল থেকে এইডস, যক্ষ্মা ও ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে কাজ করে ৭ কোটি মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে।

তিনি বলেন, “জন্ম কোথায় হবে তা নিয়তির বিষয়। তবে বেঁচে থাকা বা চিকিৎসা পাওয়া যেন ভাগ্যের ওপর নির্ভর না করে। এজন্য ধনী দেশগুলোকে তাদের বাজেটের একটি অংশ দরিদ্র দেশের স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করতে হবে।”

বিল গেটস আরও বলেন, “আমি আমার প্রায় সব সম্পদ আগামী ২০ বছরে স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ করব। কিন্তু শুধুমাত্র ব্যক্তিগত উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। সরকারেরও অবশ্যই এগিয়ে আসতে হবে।”

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ

দারিদ্র্য দেশগুলো তাদের বাজেটের মাত্র ৩ শতাংশেরও কম স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করে। এর পেছনে মূল কারণ ঋণের বোঝা এবং উচ্চসুদের চাপ। বিল গেটস বৈশ্বিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, যেন তারা ঋণের চাপ কমিয়ে স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগের পথ সুগম করে।

তবে চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও গেটস আশাবাদী। তিনি বলেন, “দুইটি বিষয় একসঙ্গে সত্য। বিশ্বজুড়ে শিশুদের স্বাস্থ্য সংকট ভয়াবহ, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে সম্ভাবনা আশার চেয়েও উজ্জ্বল।”

বিজ্ঞান, উদ্ভাবন ও অনুপ্রেরণা

গেটস বলেন, বিজ্ঞান দ্রুত এগোচ্ছে। মানুষ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে নতুন আবিষ্কারগুলো যেন প্রতিটি শিশুর কাছে পৌঁছে যায়, সে চেষ্টা করছে। তিনি নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করে বলেন, “প্রতিদিন আমি অনুপ্রাণিত হই অনেক মানুষের কাছ থেকে। যেমন—ড. ওপেইয়েমি আকিনাজো, যিনি এআই-ভিত্তিক সেন্সর তৈরি করছেন মায়েদের প্রসবকালীন মৃত্যু কমাতে। অথবা ইন্দোনেশিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রী বুদি সাদিকিন, যিনি শিশুদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে কাজ করছেন।”

যুক্তরাষ্ট্রের দুই কিশোর-কিশোরী, ম্যাডি ও এমিলি লিফলাংয়ের উদাহরণও দিয়েছেন তিনি। কেনিয়ায় স্বেচ্ছাসেবী কাজের অভিজ্ঞতা থেকে তারা এখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সহায়তার পক্ষে সোচ্চার হয়েছেন।

ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আশার বার্তা

বিল গেটস বলেন, “আমি এখন দাদু হয়েছি। চাই আমার নাতি-নাতনিরা এমন এক পৃথিবীতে বড় হোক যেখানে ম্যালেরিয়া ও এইডস শুধুমাত্র ইতিহাসের বইয়ে থাকবে, বাস্তবে নয়। যেখানে প্রতিটি শিশু সুস্থভাবে জন্মাবে এবং শৈশব পার করবে।”

তার মতে, আজকের সিদ্ধান্ত আগামী প্রজন্মের পৃথিবী কেমন হবে তা নির্ধারণ করবে। ধনী-গরিব মিলিয়ে সবাইকে স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ করতে হবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য খাতে ভবিষ্যতের কৌশল

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং গ্লোবাল ফান্ডের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাস্থ্য সেবা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিচ্ছে। নীতি প্রণয়ন, গবেষণা ও উদ্ভাবন, এবং দরিদ্র দেশে টিকা ও ওষুধ পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে শিশু মৃত্যুহার কমানো সম্ভব। বিল গেটসের মতো উদ্যোগপতির সম্পদ এবং ধনী দেশের সমন্বিত অর্থায়ন একসাথে কাজ করলে শিশুদের জীবনধারণে বড় পরিবর্তন আনা সম্ভব।

উল্লেখযোগ্য যে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শিশু মৃত্যুহার কমানোই বিশ্বের সবচেয়ে বড় জনস্বাস্থ্য সাফল্যের মধ্যে একটি। তবে বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সংকট এখনও বিদ্যমান। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুসারে, প্রতি বছর ৫ বছরের কম বয়সী প্রায় ৪৯ লাখ শিশু মৃত্যু ঘটছে, যার অধিকাংশই দরিদ্র দেশে। সঠিক বিনিয়োগ, প্রযুক্তি ও নীতিমালা প্রয়োগ করলে এই সংখ্যা আরও কমানো সম্ভব।

বিল গেটসের পরিকল্পনা অনুযায়ী, আগামী ২০ বছরে বৈশ্বিক শিশু মৃত্যুহার অর্ধেক কমানো এবং ম্যালেরিয়া, এইডস, যক্ষ্মার মতো রোগ নির্মূল করা সম্ভব। তিনি ব্যক্তিগত সম্পদ, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং বৈশ্বিক অর্থায়নের সমন্বয়ে এই লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা করছেন।

বিল গেটসের উদ্যোগ আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, স্বাস্থ্য একটি মৌলিক অধিকার। জন্মের সঙ্গে কোনো শিশুর জীবন ঝুঁকিতে থাকা উচিত নয়। ধনী দেশ, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এবং দাতব্য সংস্থা একসাথে কাজ করলে বিশ্ব স্বাস্থ্য খাতকে শক্তিশালী করা সম্ভব। আজকের বিনিয়োগ আগামী প্রজন্মের সুস্থ ও নিরাপদ ভবিষ্যতের ভিত্তি গড়ে দেবে।

MAH – 12955 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement
Back to top button