
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস সতর্ক করে বলেছেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি ঐক্যবদ্ধভাবে ফিলিস্তিনের পাশে না দাঁড়ায়, তবে ইসরায়েল গাজা ও দখলকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে আগ্রাসন চালিয়ে যাবে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের আসন্ন অধিবেশনের প্রাক্কালে দেওয়া তাঁর এই মন্তব্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
জাতিসংঘ মহাসচিবের উদ্বেগ
গুতেরেস বলেন, গাজায় চলমান হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসযজ্ঞ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের সুস্পষ্ট উদাহরণ। বিশ্ব যদি কেবল নীরব দর্শক হয়ে থাকে, তবে এই আগ্রাসন থামবে না বরং আরও বিস্তৃত হবে। তাঁর মতে, দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানই এই সংকটের একমাত্র কার্যকর পথ, কিন্তু বাস্তবে তা থেকে বিশ্ব দূরে সরে যাচ্ছে।
তিনি আরও যোগ করেন, “মানুষ এখন শুধু বিবৃতি শুনতে চায় না, তারা বাস্তব পদক্ষেপ দেখতে চায়। যদি ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য অধিকার অস্বীকৃত হতে থাকে, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি অচিরেই ভেঙে পড়বে।”
দীর্ঘদিনের সংঘাত ও প্রেক্ষাপট
ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংকট কয়েক দশক ধরে চলে আসছে। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে ফিলিস্তিনিদের জমি দখল, উদ্বাস্তুতে পরিণত করা এবং গাজা ও পশ্চিম তীরে সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে আসছে তেল আবিব। ২০০৭ সালে গাজা উপত্যকার নিয়ন্ত্রণ হামাসের হাতে যাওয়ার পর থেকে অবরোধ আরও কঠোর হয়েছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের পাল্টা হামলার পর ইসরায়েল গাজায় নজিরবিহীন সামরিক অভিযান শুরু করে। তখন থেকে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছে, ধ্বংস হয়েছে হাসপাতাল, স্কুল, আবাসিক ভবন। জাতিসংঘ ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদন বলছে, এখন পর্যন্ত নিহতদের অর্ধেকেরও বেশি নারী ও শিশু।
মানবিক বিপর্যয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
গাজায় চলমান ইসরায়েলি আগ্রাসনে মানবিক সংকট ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। পানীয় জল, খাদ্য, চিকিৎসা সামগ্রী এবং বিদ্যুতের অভাবে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা স্থবির হয়ে পড়েছে। জাতিসংঘের তথ্যমতে, প্রায় দুই মিলিয়নেরও বেশি মানুষ মানবিক সহায়তার জন্য অপেক্ষা করছে।
যদিও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ হচ্ছে, কিন্তু রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বড় শক্তিগুলো বিভক্ত। যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যে ইসরায়েলের সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে, অপরদিকে ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার কিছু দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
সাধারণ পরিষদের আলোচনায় ফিলিস্তিন ইস্যু
আগামী সপ্তাহে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশন শুরু হতে যাচ্ছে। সেখানে প্রায় ১৪০ জন রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান অংশ নেবেন। এ অধিবেশনের মূল আলোচ্য বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম হবে ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং গাজায় মানবাধিকার সংকট।
সৌদি আরব ও ফ্রান্স যৌথভাবে ‘দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান’ নিয়ে বিশেষ বৈঠকের আয়োজন করেছে। আশা করা হচ্ছে, কয়েকটি দেশ এই অধিবেশনে আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি ঘোষণা করবে।
বিশ্লেষকদের মতামত
বিশেষজ্ঞদের মতে, গুতেরেসের সতর্কবার্তা শুধু নৈতিক দায়বদ্ধতা নয়, বরং বিশ্বনেতাদের জন্য একটি চাপ সৃষ্টির বার্তা। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের বিশ্লেষকরা মনে করেন, ফিলিস্তিনকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়ার পাশাপাশি ইসরায়েলের ওপর অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক চাপ বাড়ানো ছাড়া এই আগ্রাসন থামানো সম্ভব নয়।
একই সঙ্গে বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন, যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়, তবে মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত আরও জটিল আকার ধারণ করবে এবং বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়বে।
জাতিসংঘ মহাসচিবের বক্তব্য স্পষ্ট—বিশ্ব যদি ফিলিস্তিনের পাশে দাঁড়াতে ব্যর্থ হয়, তাহলে ইসরায়েলের আগ্রাসন বন্ধ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এখন প্রশ্ন হলো, বড় শক্তিগুলো নিজেদের স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে সত্যিকার অর্থে মানবিক মূল্যবোধকে প্রাধান্য দিতে পারবে কি না। আসন্ন জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ হয়তো এর একটি দিকনির্দেশনা দেবে।
এম আর এম – ১৪২১,Signalbd.com