বাংলাদেশ

যাত্রাবাড়ীতে বাসায় এসি বিস্ফোরণে একই পরিবারের চারজন দগ্ধ

Advertisement

ঢাকায় ভয়াবহ দুর্ঘটনা, বিশেষজ্ঞরা বলছেন—অসতর্ক ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবই মূল কারণ

রাজধানী ঢাকার যাত্রাবাড়ীর ধলপুর এলাকায় শুক্রবার গভীর রাতে এক ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে। একটি ফ্ল্যাটে হঠাৎ এসি বিস্ফোরণে একই পরিবারের চারজন সদস্য দগ্ধ হন। রাত প্রায় দেড়টার দিকে এই দুর্ঘটনা ঘটে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন।

দগ্ধদের তাৎক্ষণিকভাবে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের জরুরি বিভাগে ভর্তি করা হয়েছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তাদের অবস্থা গুরুতর হলেও দ্রুত চিকিৎসা চলছে।

দগ্ধদের পরিচয়

দগ্ধরা হলেন—

  • মো. তুহিন হোসেন (৩৮) – পরিবারপ্রধান
  • ইবা আক্তার (৩০) – তার স্ত্রী
  • তানভীর (৯) – তাদের বড় ছেলে
  • তাওহীদ (৭) – ছোট ছেলে

চারজনই বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।

কীভাবে ঘটলো বিস্ফোরণ?

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, গভীর রাতে হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দ শোনা যায়। মুহূর্তের মধ্যে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ধারণা করা হচ্ছে, এসির কম্প্রেসর অতিরিক্ত চাপ সহ্য করতে না পেরে বিস্ফোরণ ঘটেছে। বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে পুরো ঘরে আগুন লেগে যায় এবং পরিবারটির চার সদস্যই গুরুতর দগ্ধ হন।

ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা প্রাথমিকভাবে ধারণা করছেন, এসির রক্ষণাবেক্ষণের অভাব, বিদ্যুতের ভোল্টেজ ওঠানামা কিংবা অভ্যন্তরীণ প্রযুক্তিগত ত্রুটি থেকে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটের চিকিৎসকের মন্তব্য

জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসক জানান—

“দগ্ধ চারজনের শরীরের ৩০ থেকে ৪৫ শতাংশ পুড়ে গেছে। শিশুদের অবস্থা বিশেষভাবে চিন্তার কারণ। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি তাদের চিকিৎসা দিতে।”

ঢাকায় এসি বিস্ফোরণের ঘটনা ক্রমবর্ধমান

ঢাকাসহ সারা দেশে গত কয়েক বছরে এসি বিস্ফোরণের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। শুধু গ্রীষ্মকাল নয়, প্রায় সারা বছরই এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে মানহীন যন্ত্রপাতি, অবহেলা এবং সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাব এ সমস্যার অন্যতম কারণ।

২০২২ সালে বনানীতে একটি বহুতল ভবনে এসি বিস্ফোরণে ২ জন নিহত এবং অন্তত ১০ জন দগ্ধ হন। একইভাবে ২০২৩ সালে নারায়ণগঞ্জে একটি মসজিদে এসি বিস্ফোরণে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে, যাতে বহু মানুষ প্রাণ হারান। এসব ঘটনাই প্রমাণ করে, সচেতনতার অভাব কতটা মারাত্মক হতে পারে।

কেন ঘটে এসি বিস্ফোরণ?

প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের মতে, এসি বিস্ফোরণের পেছনে কয়েকটি মূল কারণ রয়েছে—

  1. অতিরিক্ত গ্যাস ভরানো – এসির ভেতরে গ্যাস বেশি ভরলে চাপ বেড়ে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে।
  2. বিদ্যুতের ভোল্টেজ ওঠানামা – হঠাৎ ভোল্টেজ বেড়ে গেলে কম্প্রেসরে শর্ট সার্কিট হয়।
  3. রক্ষণাবেক্ষণের অভাব – দীর্ঘদিন এসি সার্ভিস না করলে এর ভেতরে ধুলো, কার্বন জমে বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি করে।
  4. মানহীন যন্ত্রাংশ – সস্তা ও নকল যন্ত্রাংশ ব্যবহার করলে বিস্ফোরণের ঝুঁকি বাড়ে।
  5. অযথা চালু রাখা – সারাদিন ও সারারাত একটানা চালু রাখলেও যন্ত্রের ওপর চাপ পড়ে।

প্রতিরোধে করণীয়

ফায়ার সার্ভিস ও প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের মতে, সচেতনতা বাড়ানো ছাড়া এ দুর্ঘটনা রোধ সম্ভব নয়। তাদের পরামর্শ—

  • নিয়মিত এসি সার্ভিস করানো
  • ভোল্টেজ স্ট্যাবিলাইজার ব্যবহার করা
  • মানসম্মত ব্র্যান্ডের যন্ত্রাংশ ব্যবহার করা
  • ঘুমের আগে ও দীর্ঘ সময় বাইরে গেলে এসি বন্ধ রাখা
  • এসির আশপাশে দাহ্য পদার্থ না রাখা
  • বিদ্যুৎ লাইনে শর্ট সার্কিট এড়াতে মানসম্মত তার ব্যবহার করা

সাধারণ মানুষের ভয় ও আতঙ্ক

ঘটনার পর ধলপুর এলাকার বাসিন্দারা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। অনেকেই বলছেন, তারা রাতভর ঘুমাতে পারেননি। স্থানীয় এক প্রতিবেশী বলেন—

“আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম ভূমিকম্প হয়েছে। এত জোরে শব্দ হলো। পরে দেখি আগুন আর ধোঁয়া বের হচ্ছে। দ্রুত দমকলকে খবর দিই।”

সরকারের ভূমিকা ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শুধু ব্যক্তিগত সচেতনতা নয়, সরকারি উদ্যোগও জরুরি। মানহীন ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি আমদানি ও বিক্রি নিয়ন্ত্রণ না করলে দুর্ঘটনা থামানো যাবে না। পাশাপাশি গণমাধ্যম ও জনসচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া উচিত।

যাত্রাবাড়ীর এই দুর্ঘটনা আবারও প্রমাণ করলো, অসতর্কতা ও অবহেলা কীভাবে একটি পুরো পরিবারকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারে। তবে সচেতনতা, প্রযুক্তিগত মান বজায় রাখা এবং সরকারি উদ্যোগ থাকলে এসব মর্মান্তিক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করা সম্ভব।

MAH – 12900 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button