
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার সবচেয়ে ঘনবসতি শহর গাজা সিটিতে ইসরায়েলি সেনারা বৃহৎ পরিসরে স্থল হামলা শুরু করেছে। সোমবার রাত (১৫ সেপ্টেম্বর) থেকে এই হামলা শুরু হলেও এর প্রস্তুতি চলছিল কয়েক সপ্তাহ ধরে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, তাদের দুটি ডিভিশন—১৬২ ও ৯৮—শহরের ভেতরে প্রবেশ করেছে এবং ধীরে ধীরে হামলার ক্ষেত্র সম্প্রসারণ করছে।
ইসরায়েলের স্থল হামলার প্রস্তুতি ও বাহিনী
ইসরায়েলি সেনারা গত কয়েক সপ্তাহ ধরে গাজা শহরের চারপাশে অবস্থান নিয়েছে। হামলার আগে বিমান ও ড্রোন থেকে মিসাইল ও বোমা নিক্ষেপ করে শহরের উঁচু ভবনগুলো ধ্বংস করা হয়েছে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, স্থল অভিযান শুরুতে তাদের দুইটি ডিভিশনে প্রায় ২০ হাজার সেনা অংশগ্রহণ করছে। পরবর্তীতে ৩৬ নম্বর ডিভিশনও এই অভিযানকে সমর্থন করবে।
ইসরায়েলের দাবি, গাজা সিটিতে হামাসের প্রায় তিন থেকে চার হাজার সশস্ত্র যোদ্ধা রয়েছে। তাই তারা এই স্থল অভিযান চালাচ্ছে যাতে শহরের নিয়ন্ত্রণে আসা সম্ভব হয় এবং দীর্ঘদিন ধরে আটক থাকা জিম্মিদের উদ্ধার করা যায়।
গাজা শহরের পরিস্থিতি
গাজা সিটি ফিলিস্তিনের সবচেয়ে ঘনবসতি শহর। শহরটিতে প্রায় ১০ লাখ মানুষ বসবাস করে, কিন্তু ইসরায়েলি সেনাদের হামলা শুরুর আগে শহরের বাসিন্দাদের নিরাপদ এলাকায় সরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। তথাপি, শহরে এখনও প্রায় ৬ লাখ মানুষ রয়েছেন।
শহরের আবাসিক এলাকায় বিমান হামলা ও স্থল অভিযানের কারণে সাধারণ মানুষ বিপুল সংকটে পড়েছে। ত্রাণ সংস্থা এবং মানবাধিকার গ্রুপগুলো জানিয়েছে, খাদ্য, পানি এবং চিকিৎসা সেবার অভাব শহরে ক্রমবর্ধমান সংকট সৃষ্টি করেছে। শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য পরিস্থিতি সবচেয়ে উদ্বেগজনক।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
গাজা সিটিতে স্থল হামলার খবর প্রকাশ হওয়ার পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা বলেছে, চলমান সংঘাতের কারণে সাধারণ মানুষ ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ছেন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং মানবাধিকার গ্রুপ ইসরায়েলকে শহরের আবাসিক এলাকায় হামলা না চালাতে অনুরোধ জানিয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরায়েলি হামলার উদ্দেশ্য হচ্ছে হামাসের কৌশলগত অবকাঠামো ধ্বংস করা এবং শহরের নিয়ন্ত্রণে আসা। তবে তারা সতর্ক করছেন, শহরের মধ্যে থাকা লাখ লাখ সাধারণ মানুষকে লক্ষ্যবস্তু বানানো মানবাধিকার লঙ্ঘন হতে পারে।
গাজার স্বাস্থ্য ও মানবিক অবস্থা
গাজা সিটিতে স্থল হামলার কারণে হাসপাতালগুলো তীব্র চাপের মুখে পড়েছে। বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ অচল হয়ে পড়েছে অনেক এলাকায়। ডাক্তাররা জানাচ্ছেন, আহতদের জন্য পর্যাপ্ত চিকিৎসা সরবরাহ করতে পারছেন না। বিদ্যমান স্বাস্থ্য কাঠামোও স্থল হামলার আগে থেকেই সীমিত ছিল।
ত্রাণ সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক হিউম্যান রাইটস গ্রুপগুলো সতর্ক করে জানিয়েছে, গাজা সিটিতে স্থল হামলার ফলে মানবিক সংকট আরও গভীর হবে। তারা বলছে, শিশু, মহিলা এবং বৃদ্ধদের নিরাপত্তা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ।
ইসরায়েলের অবস্থান ও যুক্তি
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এবং সেনাবাহিনী তাদের হামলার যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করেছেন। তাদের দাবি, গাজা সিটিতে হামাসের কৌশলগত লক্ষ্য ধ্বংস না করলে ভবিষ্যতে আরও বড় সন্ত্রাসী হামলার ঝুঁকি থাকবে। নেতানিয়াহু বলেছেন, “গাজা শহরে আমাদের স্থল অভিযান সফল হলে দীর্ঘদিন ধরে বন্দী থাকা জিম্মিদের উদ্ধার সম্ভব হবে।”
তবে জিম্মিদের পরিবারের সদস্যরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, চলমান হামলায় তাদের প্রিয়জনরা মারা যেতে পারেন। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার গ্রুপও এ ব্যাপারে সতর্ক করেছেন।
হামলার প্রভাব ও পরবর্তী পরিস্থিতি
গাজা সিটিতে স্থল হামলার ফলে শহরের ভেতরে চলাচল কঠিন হয়ে পড়েছে। স্কুল, হাসপাতাল ও মার্কেট বন্ধ রয়েছে। হাজার হাজার মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে শহর ছেড়েছে। স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমগুলো জানাচ্ছে, শহরের মধ্যে বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ ব্যাহত হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরায়েলের এই স্থল অভিযান চলতে থাকলে গাজার মানুষের মানবিক সংকট বৃদ্ধি পাবে। খাদ্য, পানি ও চিকিৎসা সেবা পাওয়া আরও কঠিন হয়ে যাবে। বিশেষত শিশু, মহিলা এবং বৃদ্ধদের জন্য পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে।
গাজা ও মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রক্রিয়ার প্রভাব
গাজার বর্তমান স্থল হামলা মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়ার ওপরও প্রভাব ফেলবে। আন্তর্জাতিক কূটনীতিকরা বলছেন, এই সংঘাত গভীর হলে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন শান্তি আলোচনা দীর্ঘদিন স্থগিত হতে পারে। বিশেষত পশ্চিমা দেশগুলো এবং মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো এই পরিস্থিতি নজরে রাখছে।
বিশ্ব সম্প্রদায় আশঙ্কা করছে, দীর্ঘস্থায়ী স্থল অভিযান এবং বিমান হামলা গাজা শহরের জনগোষ্ঠীর ওপর স্থায়ী ক্ষতি করতে পারে। পাশাপাশি, স্থানীয় রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং নিরাপত্তা সংকট বৃদ্ধি পেতে পারে।
গাজা সিটিতে শুরু হওয়া ইসরায়েলি স্থল হামলা বর্তমানে আন্তর্জাতিক সংবাদপত্র ও সংবাদ সংস্থার মূল শিরোনাম। মানবাধিকার সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উদ্বিগ্ন, যে সাধারণ মানুষ এই সংঘাতের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হতে পারে। ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ এই শহরে হামলার পরিধি ক্রমশ বাড়তে থাকায় সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন হচ্ছে।
গাজা সিটি থেকে আসা রিপোর্ট অনুযায়ী, হাজার হাজার মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে শহরের বাইরে চলে গিয়েছেন। তবে এখনও লাখ লাখ মানুষ শহরে রয়েছেন। নিরাপত্তা ও মানবিক সহায়তার অভাবে তাদের পরিস্থিতি ক্রমশ সংকটময় হয়ে উঠছে।
সংক্ষিপ্ত বিবরণ:
- ইসরায়েলি স্থল হামলা শুরু: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫
- মূল বাহিনী: ১৬২, ৯৮ এবং পরে ৩৬ নম্বর ডিভিশন
- গাজা সিটিতে হামাস যোদ্ধার সংখ্যা: ৩-৪ হাজার
- শহরের বর্তমান বাসিন্দা: প্রায় ৬ লাখ
- প্রধান মানবিক সমস্যা: খাদ্য, পানি, চিকিৎসা, আশ্রয়
- আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া: জাতিসংঘ এবং মানবাধিকার সংস্থা উদ্বিগ্ন
MAH – 12856 Signalbd.com