রংপুরে পদ্মরাগ কমিউটার ট্রেনের ছয়টি বগি লাইনচ্যুত

রংপুরের পীরগাছা এলাকায় চলমান যাত্রীবাহী পদ্মরাগ কমিউটার ট্রেনের ছয়টি বগি লাইনচ্যুত হওয়ার ঘটনায় রেল যোগাযোগে বিশাল ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়েছে। ঘটনার ফলে রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম জেলার সম্পূর্ণ রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে এবং নীলফামারী, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড়ের আংশিক রেল সেবা প্রভাবিত হয়েছে।
স্থানীয় রেল কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) দুপুর ১২টা ৪০ মিনিটে পীরগাছা রেলস্টেশনের ২নং লাইনে ট্রেনটি লাইনচ্যুত হয়। দুর্ঘটনার সময় ট্রেনটিতে প্রায় দুই হাজার যাত্রী উপস্থিত ছিলেন। যদিও বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়নি, তবে যাত্রীরা মানসিকভাবে ভীষণভাবে প্রভাবিত হয়েছেন।
দুর্ঘটনার বিস্তারিত
পদ্মরাগ কমিউটার ট্রেনটি ঢাকা থেকে লালমনিরহাটগামী এক্সপ্রেসের ক্রসিং-এর জন্য পীরগাছা রেলস্টেশনে অবস্থান করছিল। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ক্রসিং শেষ হওয়ার পর যখন ট্রেনটি লালমনিরহাটগামী লাইন পরিবর্তন করতে চেয়েছিল, তখন লাইন সেপারেটরের একটি পয়েন্ট ভেঙে যায়, ফলে ট্রেনের ছয়টি বগি লাইনচ্যুত হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, ট্রেনটি লাইন পরিবর্তনের মাত্র ৩০০ গজ পরই লাইনচ্যুত হয়। অনেক যাত্রী অভিযোগ করেছেন, দুর্ঘটনার সময় তাদের ব্যাগপত্র ও মালামাল ভেঙে বা হারিয়ে গেছে।
পদ্মরাগ ট্রেনের একজন যাত্রী নুরবানু বলেন, “আমি আমার পাশে সিটে ব্যাগ রেখেছিলাম এবং বাথরুমে গেলাম। যখন ফিরে আসি, দেখি আমার পাশে থাকা যাত্রীর ব্যাগ এবং কিছু মালামাল লাইনচ্যুত হওয়ার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সত্যিই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি ছিল।”
রেল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য
পীরগাছা রেলওয়ে স্টেশনের মাস্টার জেনারেল ইসলাম জানান, ট্রেনটি মঙ্গলবার দুপুর সাড়ে ১২টায় সান্তাহার থেকে লালমনিরহাটগামী পথে পীরগাছা স্টেশনে পৌঁছায়। বিরতি শেষে যাত্রা শুরু করার সময় আউটার সিগনাল এলাকার লাইন সেপারেটরের প্লেট ভেঙে যায়, ফলে ইঞ্জিনের পেছনের তৃতীয় বগি থেকে চারটি বগি লাইনচ্যুত হয়।
তিনি আরও জানান, দুর্ঘটনার কারণে রংপুর এক্সপ্রেস, লালমনিরহাট এক্সপ্রেস, বুড়িমারি এক্সপ্রেস, কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস, পদ্মরাগ, দোলনচাঁপা, করতোয়া, রামসাগর কমিউটার ও নাইনটিন আপ-ডাউনসহ বেশ কয়েকটি আন্তঃনগর এবং মেইল ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। উদ্ধারকাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই রুটে ট্রেন চলাচল করা সম্ভব হবে না।
যাত্রাপথ ও যাত্রীদের অসুবিধা
রেল দুর্ঘটনার ফলে রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম জেলার সম্পূর্ণ ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ হয়েছে। এছাড়া, নীলফামারী, ঠাকুরগাঁও এবং পঞ্চগড়ের আংশিক রেল সেবা প্রভাবিত হয়েছে। এর কারণে যাত্রীরা সিডিউল অনুযায়ী গন্তব্যে পৌঁছাতে পারছেন না।
স্থানীয় যাত্রীরা জানিয়েছেন, ট্রেন চলাচল বন্ধ হওয়ায় অনেক যাত্রী বাধ্য হয়ে বিকল্প পথে বাস ও প্রাইভেট যানবাহনে সরে যাচ্ছেন। এ ঘটনায় ব্যবসায়ীদেরও ক্ষতি হচ্ছে, কারণ মালবাহী ট্রেন এবং যাত্রীবাহী ট্রেন বন্ধ থাকায় পণ্য পরিবহন ব্যাহত হচ্ছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশ রেলওয়েতে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দুর্ঘটনার পর রেলক্রেন ও উদ্ধার দল দ্রুত ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়েছে। বর্তমানে লাইনচ্যুত ট্রেন উদ্ধার এবং লাইন পুনঃস্থাপন কাজ চলছে। রেলওয়ে আশা করছে, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সাধারণ ট্রেন চলাচল পুনরায় শুরু করা সম্ভব হবে।
রেলওয়ের পক্ষ থেকে আরও বলা হয়েছে, যাত্রীদের নিরাপত্তা সর্বাধিক গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হচ্ছে। লাইনচ্যুত ট্রেন থেকে সমস্ত যাত্রীকে নিরাপদে সরিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে এবং আহতদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
পটভূমি ও ইতিহাস
রংপুর অঞ্চলে রেলপথ বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবহন মাধ্যম। প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ এই রুটে যাত্রা করেন। পদ্মরাগ কমিউটার ট্রেনটি সান্তাহার থেকে লালমনিরহাটগামী প্রধান যাত্রীবাহী ট্রেনগুলোর মধ্যে অন্যতম।
পূর্বে এই রুটে অল্প কিছু প্রযুক্তিগত সমস্যার ঘটনা ঘটলেও এত বড় আকারের লাইনচ্যুত ঘটনা বিরল। রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ট্রেনের নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করা হলেও মাঝে মাঝে পুরাতন লাইন এবং পয়েন্টের ত্রুটি এ ধরনের দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে।
নিরাপত্তা ব্যবস্থার গুরুত্ব
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের রেলপথকে আরও নিরাপদ করতে লাইন ও সিগনাল সিস্টেমের আধুনিকায়ন, নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ এবং জরুরি পরিস্থিতিতে দ্রুত সাড়া দেওয়ার ব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
একজন রেলপথ বিশেষজ্ঞ জানান, “পুরনো পয়েন্ট সিস্টেম এবং ট্রেনের ভারবহন ক্ষমতা অনুযায়ী লাইন স্থিতি পরীক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই ধরনের দুর্ঘটনা পুনরায় এড়াতে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন ও নিয়মিত প্রশিক্ষণ অপরিহার্য।”
যাত্রীদের প্রতিক্রিয়া
স্থানীয় যাত্রীরা দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তারা বলেছেন, ট্রেন চলাচলের সময় যাত্রীদের তথ্য দেয়ার ক্ষেত্রে রেলওয়ের আরও দ্রুত পদক্ষেপ প্রয়োজন। অনেক যাত্রী অনলাইনে অভিযোগ করেছেন, ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়ার কারণে তাদের ব্যাগপত্র ও ব্যক্তিগত জিনিসপত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
একজন যাত্রী বলেন, “যাত্রীদের নিরাপত্তা ও মালামালের ক্ষতি প্রতিরোধে রেলওয়েকে আরও শক্তিশালী পদক্ষেপ নিতে হবে। শুধুমাত্র দুর্ঘটনার পরে ব্যবস্থা নেওয়া যথেষ্ট নয়।”
সমাধানের পদক্ষেপ
বাংলাদেশ রেলওয়ে জানিয়েছে, তারা দুর্ঘটনার পরে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ নিচ্ছে:
- লাইনচ্যুত ট্রেন দ্রুত উদ্ধার।
- ক্ষতিগ্রস্ত রেলপথের মেরামত।
- যাত্রীদের তথ্য দিয়ে এবং বিকল্প পরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
- নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নত করা এবং ভবিষ্যতে এমন দুর্ঘটনা প্রতিরোধ।
রংপুরের পীরগাছায় পদ্মরাগ কমিউটার ট্রেনের ছয়টি বগি লাইনচ্যুত হওয়ার ঘটনায় দেশের রেল যোগাযোগ ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয়েছে। যদিও বড় ধরনের শারীরিক ক্ষতি হয়নি, তবে যাত্রী ও মালামালের ক্ষতি হয়েছে। রেলওয়েকে দ্রুত এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করতে হবে।
এ ধরনের ঘটনা ভবিষ্যতে প্রতিরোধ করতে আধুনিক প্রযুক্তি এবং নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ অপরিহার্য। বাংলাদেশ রেলওয়ে আশা করছে, কয়েক ঘন্টার মধ্যেই লাইন পুনঃস্থাপন সম্পন্ন হবে এবং চলমান ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হবে।
MAH – 12852 Signalbd.com