৫ ইসলামী ব্যাংক একীভূত হচ্ছে, সম্ভাব্য নাম ‘ইউনাইটেড ইসলামী ব্যাংক’

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ব্যাংক খাতের অস্থিতিশীলতা নিয়ে নতুন এক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সমস্যায় জর্জরিত পাঁচটি ইসলামী ব্যাংক—এক্সিম ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ইসলামী ব্যাংক এবং গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক—একীভূত হওয়ার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপ ও প্রশাসকের নিয়োগ
বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশের আওতায় প্রতিটি ব্যাংকে অস্থায়ী প্রশাসক নিয়োগ করা হবে। প্রতিটি প্রশাসককে সহায়তার জন্য চারজন করে কর্মকর্তা দেওয়া হবে। এই ব্যবস্থা মূলত ব্যাংকগুলোর কার্যক্রমে স্থিতিশীলতা আনা এবং আমানতকারীদের বিশ্বাস ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে নেওয়া হয়েছে।
অস্থায়ী প্রশাসক নিয়োগের পর, এই পাঁচটি ব্যাংকের বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদ শূন্য ঘোষণা করা হবে। অর্থাৎ নতুনভাবে একক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা গঠিত হবে।
নতুন ব্যাংকের সম্ভাব্য নাম ও লাইসেন্স
সরকারের পক্ষ থেকে নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত এই ব্যাংকের সম্ভাব্য নাম হতে পারে ‘ইউনাইটেড ইসলামী ব্যাংক’। একীভূতকরণের পর এই নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স ইস্যু করা হবে এবং পাঁচটি ব্যাংকের সম্পদ ও দায় নতুন ব্যাংকের অধীনে চলে আসবে।
অর্থমন্ত্রণালয় জানিয়েছে, নতুন ব্যাংকটি সরকারের মূলধন দিয়ে গড়ে উঠবে। একীভূতকরণের জন্য প্রয়োজনীয় ৩৫ হাজার ২০০ কোটি টাকার মধ্যে সরকার সরবরাহ করবে ২০ হাজার ২০০ কোটি টাকা। বাকী অংশের অর্থ শেয়ার বিক্রি করে ফেরত আনা হবে। এছাড়া পাঁচটি ব্যাংকের বড় আমানতকারীদেরও শেয়ার নেয়ার সুযোগ দেওয়া হবে। ছোট আমানতকারীরা চাইলে তাদের আমানত তুলে নিতে পারবে।
ব্যাংকগুলোর সমস্যার কারণ
বিগত কয়েক বছরের হিসাব অনুযায়ী, এই পাঁচ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার অত্যন্ত উদ্বেগজনক। বিশেষ করে শেখ হাসিনার সরকারের সময় কিছু ধরনের জালিয়াতির কারণে এক্সিম, সোশ্যাল, ফার্স্ট সিকিউরিটি, ইউনিয়ন এবং গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ৪৮ থেকে ৯৮ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ খেলাপি হয়ে গেছে।
অর্থ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এ ধরনের ঋণ খেলাপি ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থাকে বিপর্যস্ত করেছে এবং সাধারণ জনগণের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় বিশ্বাস নষ্ট করেছে। একীভূতকরণ এবং সরকারের সহযোগিতা ছাড়া এই ব্যাংকগুলোকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।
একীভূতকরণের প্রক্রিয়া
বেসরকারি ও ইসলামী ব্যাংক বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, একীভূতকরণের প্রক্রিয়ায় নিম্নলিখিত ধাপগুলো অনুসরণ করা হবে:
- প্রশাসক নিয়োগ: পাঁচটি ব্যাংকে অস্থায়ী প্রশাসক এবং চারজন করে সহকারী কর্মকর্তার মাধ্যমে ব্যাংকের দৈনন্দিন কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ।
- পরিচালনা পর্ষদ শূন্যকরণ: বিদ্যমান পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদ শূন্য হবে।
- নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স ইস্যু: নতুন ব্যাংক ‘ইউনাইটেড ইসলামী ব্যাংক’ নামে সরকারি লাইসেন্স লাভ করবে।
- সম্পদ ও দায়ের স্থানান্তর: পাঁচটি ব্যাংকের সমস্ত সম্পদ ও দায় নতুন ব্যাংকের অধীনে স্থানান্তরিত হবে।
- শেয়ার বিক্রয় ও মূলধন সরবরাহ: সরকারের অংশ ২০ হাজার ২০০ কোটি টাকা সরবরাহ, বাকি ১৫ হাজার কোটি টাকা শেয়ার বিক্রি ও বড় আমানতকারীদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সংগ্রহ।
সরকারের আর্থিক সহযোগিতা ও বাজেট প্রভাব
অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, নতুন ব্যাংক গঠনের জন্য সরকারের বাজেট থেকে বড় অর্থসংস্থান করা হয়েছে। এটি দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এছাড়া নতুন ব্যাংকের মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকি কমানো এবং আমানতকারীদের আস্থা পুনঃস্থাপন করা সম্ভব হবে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সরকারের মূলধনের মাধ্যমে এই ব্যাংক গঠন দেশের ব্যাংকিং খাতের পুনরুদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
আমানতকারীদের জন্য নির্দেশনা
নতুন ব্যাংকের আমানত ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত নিয়মাবলী প্রযোজ্য হবে:
- ছোট আমানতকারীদের নিশ্চয়তা: যারা চাইবেন, তারা তাদের আমানত নিরাপদে তুলে নিতে পারবেন।
- বড় আমানতকারীদের অংশগ্রহণ: বড় আমানতকারীদের শেয়ার নেয়ার প্রস্তাব দেওয়া হবে।
- নতুন শেয়ার ইস্যু: সরকার এবং বিনিয়োগকারীরা নতুন শেয়ারের মাধ্যমে মূলধন পুনঃস্থাপন করবে।
ব্যাংক একীভূতকরণের আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট
বিশ্বব্যাংক এবং এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী, খেলাপি ঋণ ও ব্যাংকিং অস্থিতিশীলতা অনেক উন্নয়নশীল দেশে সাধারণ সমস্যা। বাংলাদেশে এই ধরনের একীভূতকরণ প্রথম নয়, তবে ইসলামী ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে এটি বিরল এবং উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, একীভূত ব্যাংক পরিচালনা হলে দেশের ব্যাংকিং খাতের বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে, নতুন বিনিয়োগ আকৃষ্ট হবে এবং আর্থিক বাজার স্থিতিশীল হবে।
একীভূতকরণের সম্ভাব্য প্রভাব
১. অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি: খেলাপি ঋণ কমানো এবং সম্পদ পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে।
২. গ্রাহক আস্থা পুনঃস্থাপন: ছোট ও বড় আমানতকারীদের ব্যাংক ব্যবস্থায় আস্থা বৃদ্ধি।
৩. শেয়ার বাজারে প্রভাব: নতুন শেয়ার ইস্যু এবং বড় আমানতকারীর অংশগ্রহণের মাধ্যমে শেয়ার বাজারে ইতিবাচক প্রভাব।
৪. কর্মসংস্থান এবং ব্যাংকিং খাতে দক্ষতা বৃদ্ধি: একীভূতকরণের মাধ্যমে আধুনিক ব্যাংকিং প্রযুক্তি এবং দক্ষতা ব্যবহার সহজতর হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয় একীভূতকরণের প্রক্রিয়া তদারকি করবে। আগামী মাসগুলোতে নতুন ব্যাংকের কার্যক্রম শুরু হলে দেশের ইসলামী ব্যাংকিং খাতের নতুন অধ্যায় শুরু হবে।
বিশেষজ্ঞরা আশা করছেন, একীভূতকরণ সফল হলে দেশের অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে, ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে এবং সাধারণ জনগণের ব্যাংক ব্যবস্থায় আস্থা দৃঢ় হবে।
MAH – 12847 Signalbd.com