বিশ্ব

ভারতে মুসলিম পরিচয় মুছে ফেলার নীতি: করিমগঞ্জের নাম পরিবর্তন ‘শ্রীভূমি’

ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে মুসলিম সম্প্রদায়ের ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং পরিচয় ধাপে ধাপে মুছে ফেলার একটি পরিকল্পিত রাজনীতি চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। কখনও মসজিদ বা ধর্মীয় স্থানের উপর বিতর্ক তৈরি করা হচ্ছে, কখনও মুসলিম নামযুক্ত শহর বা জেলার নাম পরিবর্তনের মতো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে বিজেপি সরকারের অধীনে এই ধরনের সিদ্ধান্তগুলো দেশজুড়ে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে উদ্বেগ ও অসন্তোষ সৃষ্টি করছে। সাম্প্রতিক উদাহরণ হিসেবে অসমের করিমগঞ্জ জেলার নাম পরিবর্তন করে ‘শ্রীভূমি’ রাখা হয়েছে, যা শুধু একটি নাম পরিবর্তন নয়, বরং ভারতীয় মুসলিমদের সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক পরিচয়ে আঘাত হিসেবে দেখা হচ্ছে।

করিমগঞ্জ থেকে শ্রীভূমি: নাম পরিবর্তনের বিতর্ক

অসম সরকার সম্প্রতি ঘোষণা করেছে যে, করিমগঞ্জ জেলার নাম পরিবর্তন করে ‘শ্রীভূমি’ করা হবে। এই ঘোষণা অসমের মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। এলাকাবাসী এবং বিভিন্ন মুসলিম সংগঠন সরকারের এই পদক্ষেপকে সংস্কৃতি ও পরিচয় হরণ হিসেবে দেখছে।

প্রতিবাদকারীরা রাস্তায় নেমে প্ল্যাকার্ড হাতে বিক্ষোভ করেছেন এবং স্লোগান দিয়েছেন,
করিমগঞ্জ কেবল একটি নাম নয়, এটি আমাদের ইতিহাস ও পরিচয়।

সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে স্থানীয় এবং আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে উত্তেজনা লক্ষ্য করা গেছে। বামপন্থী ও অধিকার সংগঠনগুলোও নাম পরিবর্তনের নিন্দা জানিয়েছে এবং অভিযোগ করেছে যে, এই ধরনের পদক্ষেপ জনগণের সঙ্গে কোনও পরামর্শ ছাড়াই নেওয়া হয়েছে।

আঞ্চলিক ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া

আঞ্চলিক দলের মুখপাত্র রাকেশ শর্মা বলেন,
“করিমগঞ্জের একটি দীর্ঘ ঐতিহাসিক পরিচয় রয়েছে। বহু প্রজন্ম ধরে এখানে বসবাসকারী মানুষদের সঙ্গে পরামর্শ না করেই জেলা নাম পরিবর্তন করা হয়েছে, যা স্পষ্টতই জনগণের প্রতি অবহেলার পরিচয়।”

রাজনীতিবিদরা মনে করছেন, বিপ্লবী ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক স্থানগুলোর নাম পরিবর্তনের মতো সিদ্ধান্ত দেশজুড়ে সামাজিক উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে। বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন যে, নাম পরিবর্তন শুধু প্রশাসনিক নয়, এটি সম্প্রদায়িক বিভাজন এবং পরিচয় সংকটে অবদান রাখতে পারে

বিজেপির নাম পরিবর্তন নীতি: একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া

ভারতের অন্যান্য বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতেও মুসলিম নামযুক্ত শহর, জেলা এবং স্থানগুলোর নাম পরিবর্তনের নজির লক্ষ্য করা গেছে। বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক প্রতীক ও দেবস্থলকে সামনে রেখে ‘হিন্দুত্ব’ কেন্দ্রিক প্রচারণা চালানো হচ্ছে।

ডানপন্থী রাজনৈতিক নেতারা সোশ্যাল মিডিয়ায় এবং বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে নাম পরিবর্তনের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন। তাদের যুক্তি, এটি ‘ঐতিহ্য রক্ষা’ এবং ‘দেশাত্মবোধ জাগানোর’ একটি পদক্ষেপ। তবে, বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই ধরনের পদক্ষেপ ভিন্ন সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক অধিকারকে হুমকির মুখে ফেলে

মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া

অসমের মুসলিম সম্প্রদায় মনে করছে যে, করিমগঞ্জের নাম পরিবর্তন তাদের পরিচয়কে বাতিল করার একটি অংশ। স্থানীয় ইসলামিক সংগঠনগুলো সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে নোটিশ প্রকাশ করেছে এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার কাছে অভিযোগ দায়ের করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

মুসলিম নেতা মুহাম্মদ আজিজ বলেন,
“নাম পরিবর্তন শুধু প্রশাসনিক কাজ নয়, এটি আমাদের সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং সমাজে একটি অদৃশ্য আঘাত। সরকার যদি আমাদের সঙ্গে পরামর্শ না করে এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়, তা হলে আমরা শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করতে বাধ্য হব।”

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব

নাম পরিবর্তন কেবল একটি প্রশাসনিক পদক্ষেপ নয়। এটি সাংস্কৃতিক পরিচয়, ঐতিহ্য এবং সম্প্রদায়ের আবেগের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। করিমগঞ্জের নাম পরিবর্তন ‘শ্রীভূমি’ করা হয়েছে, যা স্থানীয় মানুষের স্মৃতিচিহ্ন ও ইতিহাসকে অস্বীকার করার চেষ্টার মতো মনে হচ্ছে।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই ধরনের পদক্ষেপ ভবিষ্যতে সামাজিক বিভাজন এবং সম্প্রদায়িক সংঘর্ষের কারণ হতে পারে। এর ফলে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে হতাশা এবং অসন্তোষ বৃদ্ধি পাবে।

আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণ

বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার সংস্থা ও আন্তর্জাতিক মিডিয়া ভারতীয় মুসলিমদের বিরুদ্ধে পরিচয় ও ইতিহাস মুছে ফেলার পদক্ষেপের বিষয়ে সতর্ক বার্তা দিয়েছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এই ঘটনার সমালোচনা করা হয়েছে এবং সরকারের নীতি সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য হরণ এবং সংখ্যালঘু বিরোধী প্রক্রিয়া হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

এক আন্তর্জাতিক সংস্থা জানিয়েছে,
“এ ধরনের পদক্ষেপ মানবাধিকার এবং সাংস্কৃতিক অধিকার লঙ্ঘন করতে পারে। স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে পরামর্শ না করে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া গুরুতর সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রভাব ফেলতে পারে।”

বিশ্লেষকরা কী বলছেন

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, করিমগঞ্জের মতো নাম পরিবর্তন শুধুমাত্র প্রশাসনিক পরিবর্তন নয়। এটি দেশজুড়ে সম্প্রদায়িক বিভাজন সৃষ্টি এবং রাজনৈতিক আগ্রাসনের একটি অংশ

ড. অরবিন্দ কুমার, একজন সমাজবিজ্ঞানী বলেন,
“নাম পরিবর্তন বা সাংস্কৃতিক স্থানগুলোকে হ্রাস করা, দীর্ঘমেয়াদে সামাজিক শান্তি ও সংহতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এটি শুধুমাত্র স্থানীয় সম্প্রদায় নয়, পুরো দেশের জন্য উদ্বেগের বিষয়।”

করিমগঞ্জ থেকে শ্রীভূমি নামকরণের ঘটনাটি শুধুমাত্র একটি প্রশাসনিক পদক্ষেপ নয়। এটি ভারতীয় মুসলিমদের ঐতিহ্য, ইতিহাস এবং সাংস্কৃতিক পরিচয় রক্ষার প্রশ্ন। সরকার যদি জনগণের সঙ্গে পরামর্শ না করে এই ধরনের পদক্ষেপ চালিয়ে যায়, তা হলে ভবিষ্যতে দেশজুড়ে সামাজিক অস্থিরতা এবং সম্প্রদায়িক সংঘাত বাড়তে পারে।

এমন পরিস্থিতিতে সমাজের সকল স্তরের মানুষের দায়িত্ব, তারা হোক সাধারণ নাগরিক, রাজনৈতিক নেতা, মানবাধিকার কর্মী বা বিশ্লেষক—সঠিক তথ্য ছড়িয়ে দেওয়া, শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে অংশ নেওয়া এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষা করা।

MAH – 12775,  Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Advertisement
Back to top button