বিক্ষোভের আগুনে জ্বলছে ফ্রান্স, গ্রেফতার ৪ শতাধিক

ফ্রান্সজুড়ে সরকারবিরোধী বিক্ষোভে উত্তাল দেশ। রাজধানী প্যারিসসহ বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভকারীরা রাস্তায় নেমে আগুন ধরিয়ে দেন, অবরোধ তৈরি করেন এবং পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ান। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৪ শতাধিক বিক্ষোভকারীকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ এবং ব্যয় সংকোচন নীতির বিরোধিতা করেই এই আন্দোলনের সূত্রপাত।
ঘটনাবলির বিস্তারিত
বুধবার (১০ সেপ্টেম্বর) ফ্রান্সজুড়ে বিক্ষোভকারীরা রাস্তায় নামেন। শুধু রাজধানী প্যারিসেই নয়, রেনে, লিঁও, মার্সেইসহ বিভিন্ন শহরে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। “ব্লক এভরিথিং” (সব কিছু অচল করে দাও) কর্মসূচির আওতায় তারা মহাসড়ক অবরোধ করেন, ব্যারিকেডে আগুন ধরান এবং ট্রেন চলাচল ব্যাহত করেন। অনেক জায়গায় সরকারি স্থাপনায় হামলার ঘটনাও ঘটে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার প্রায় ৮০ হাজার পুলিশ মোতায়েন করে। তবে তাতেও উত্তেজনা প্রশমিত হয়নি। প্যারিসের বিভিন্ন রাস্তায় পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। টিয়ারশেল ও জলকামান ব্যবহার করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে কর্তৃপক্ষ।
বিক্ষোভের পেছনের কারণ
ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ সম্প্রতি কৃচ্ছ্রনীতি বা ব্যয় সংকোচন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ঘোষণা দেন। এর ফলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানে বরাদ্দ কমে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ সিদ্ধান্ত তরুণ প্রজন্মের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ তৈরি করেছে।
এরই মধ্যে ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী ফ্রঁসোয়া বায়রু সংসদে আস্থা ভোটে হেরে পদত্যাগ করেন। তার স্থলাভিষিক্ত হন প্রেসিডেন্টের ঘনিষ্ঠ সহযোগী সেবাস্তিয়ান লেকর্নু। কিন্তু নতুন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের দিনেই দেশজুড়ে আন্দোলনের বিস্ফোরণ ঘটে।
গণগ্রেফতার ও সরকারি প্রতিক্রিয়া
ফরাসি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ব্রুনো রেতাইয়ো জানান, এ আন্দোলনে প্রায় দুই লাখ মানুষ অংশ নেয়। তবে সিজিটি ইউনিয়ন দাবি করেছে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা আড়াই লাখের বেশি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এ ঘটনায় অন্তত ৪৫০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে অনেকেই ইচ্ছাকৃতভাবে সহিংস কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন বলে অভিযোগ। পুলিশ জানিয়েছে, বিক্ষোভকারীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সংগঠিত হয়ে এ আন্দোলনে অংশ নেন, যার কোনো কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নেই।
আগের বিক্ষোভের প্রেক্ষাপট
ফ্রান্সে শ্রমবাজার সংস্কার, কর নীতি ও অবসর সুবিধা নিয়ে আগে থেকেই অসন্তোষ বিদ্যমান। গত বছর অবসর বয়স বাড়ানোর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধেও ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছিল। সেসময়ও রাস্তায় লাখ লাখ মানুষ নেমে এসেছিলেন। এবারের আন্দোলন সেই ধারাবাহিক ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
অর্থনীতি ও দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব
বিক্ষোভ ও অবরোধের কারণে ফ্রান্সের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। বিভিন্ন ট্রেন সেবা বন্ধ হয়ে যায়, গণপরিবহন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। বাণিজ্যিক কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পশ্চিমাঞ্চলের রেনে শহরে একটি গণপরিবহন বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।
অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করেছেন, আন্দোলন দীর্ঘস্থায়ী হলে দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ব্যবসায়িক বিনিয়োগ কমে যেতে পারে, পর্যটন খাত ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
বিক্ষোভকারীদের দাবি ও প্রতিক্রিয়া
বিক্ষোভকারীরা মনে করছেন, জনগণের দাবিকে উপেক্ষা করে প্রেসিডেন্ট তার ঘনিষ্ঠজনকে প্রধানমন্ত্রী করেছেন। তাদের মতে, সংসদ ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচন অথবা একজন বামপন্থি নেতাকে নিয়োগ দেওয়া উচিত ছিল।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বার্তায় তারা বলছে, শুধু ব্যয় সংকোচন নয়, বরং শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও সামাজিক বৈষম্যের মতো সমস্যাগুলোর প্রতিও সরকারের নজর দিতে হবে।
বিশ্লেষকদের মত
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এ আন্দোলন শুধু সরকারের নীতি বিরোধী নয়, বরং এটি বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি মানুষের অবিশ্বাসের বহিঃপ্রকাশ। ফ্রান্সে ক্ষমতাসীন দলের প্রতি আস্থা ক্রমেই কমে যাচ্ছে।
তাদের মতে, যদি সরকার জনগণের উদ্বেগের প্রতি গুরুত্ব না দেয়, তবে এ আন্দোলন আরও বড় আকার ধারণ করতে পারে। একইসঙ্গে ইউরোপের অন্যান্য দেশেও এর প্রভাব পড়তে পারে।
পরিশেষে
ফ্রান্সের বর্তমান পরিস্থিতি এক অনিশ্চয়তার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। একদিকে সরকার ব্যয় সংকোচন পরিকল্পনা এগিয়ে নিতে চাইছে, অন্যদিকে সাধারণ মানুষ তাদের অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা রক্ষার দাবিতে রাস্তায় নেমেছে। আগামী দিনে আন্দোলনের গতি কোন দিকে যাবে তা অনেকটাই নির্ভর করছে সরকারের সিদ্ধান্ত ও জনগণের প্রতিক্রিয়ার ওপর।
এম আর এম – ১২৯১,Signalbd.com