আঞ্চলিক

ফরিদপুরে সীমানা পুনর্বিন্যাসের প্রতিবাদে সড়ক অবরোধ, যানজট ২৩ কিমি

ফরিদপুরে সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্বিন্যাসের প্রতিবাদে আবারও মহাসড়ক অবরোধের ঘটনা ঘটেছে। ভাঙ্গা উপজেলার আলগী ও হামিরদী ইউনিয়নকে ফরিদপুর-৪ আসন থেকে কেটে ফরিদপুর-২ আসনের সঙ্গে যুক্ত করার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে স্থানীয়রা সকাল ৮টা থেকে ঢাকা-খুলনা এবং ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে অবস্থান নেন। এর ফলে দুই মহাসড়কে প্রায় ২৩ কিলোমিটার দীর্ঘ যানজট তৈরি হয় এবং ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার সড়ক যোগাযোগ কার্যত বন্ধ হয়ে যায়।

অবরোধের পেছনের কারণ

নির্বাচন কমিশন গত ৪ সেপ্টেম্বর গেজেট প্রকাশ করে, ভাঙ্গা উপজেলার আলগী ও হামিরদী ইউনিয়নকে ফরিদপুর-৪ আসন থেকে কেটে ফরিদপুর-২ আসনের সঙ্গে যুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সিদ্ধান্তে ভাঙ্গার মানুষ অসন্তুষ্ট এবং তারা মনে করেন, তাদের এলাকায় কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে স্থানীয়দের সঙ্গে পরামর্শ করা হয়নি। স্থানীয়রা জানান, “ভাঙ্গাকে কোনোভাবেই বিভক্ত করা হবে না। আমরা ভাঙ্গার মানুষ, ভাঙ্গাতেই থাকতে চাই।”

অবরোধের সময়সূচি ও পরিস্থিতি

মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর) সকাল সোয়া আটটার পর থেকেই অবরোধ শুরু হয়। ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের হামিরদী ইউনিয়নের পুকুরিয়া ও মাধবপুর বাসস্ট্যান্ড, ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের মুনসুরাবাদ বাসস্ট্যান্ড ও আলগী ইউনিয়নের সুয়াদী এলাকায় স্থানীয়রা অবস্থান নেন। অবরোধকারীরা রাস্তার মধ্যে টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে, বাঁশ ও কাঠ ফেলে যান চলাচল বন্ধ করেন। এমনকি রাস্তায় ঘুমানোর চৌকি ফেলে পুরো এলাকায় অবরোধ সৃষ্টি হয়।

এর ফলে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের তালমার মোড় থেকে পুকুরিয়া পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার এবং ভাঙ্গা দক্ষিণপাড় থেকে টেকেরহাট পর্যন্ত ৩ কিলোমিটার এলাকায় যানজট তৈরি হয়। ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের মিলিগ্রাম থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত ৬ কিলোমিটার এবং সুয়াদী থেকে জয় বাংলা মোড় পর্যন্ত অন্তত ২ কিলোমিটার যানজট দেখা যায়।

মোট মিলিয়ে দুই মহাসড়কে অন্তত ২৩ কিলোমিটার যানজট সৃষ্টি হয়। এই অবস্থায় ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে অন্তত ১৫ কিলোমিটার এবং ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে আট কিলোমিটার এলাকায় শত শত বাস, ট্রাক, ও ব্যক্তিগত গাড়ি আটকা পড়ে। ফলে হাজারো যাত্রী ভোগান্তিতে পড়েন।

যাত্রীদের ভোগান্তি

ফরিদপুর শহর থেকে ভাঙ্গার দিকে যাচ্ছিলেন শারমিন আক্তার নামে একজন শিক্ষক। তিনি বলেন, “ঢাকা থেকে ভাঙ্গার পথে আমাকে তালমার মোড়ে নামতে বাধ্য করা হয়। সামনে আবার অবরোধ রয়েছে। তাই হেটে স্কুলের দিকে যাচ্ছি। জানি না কখন পৌঁছাব। তবে ভাঙ্গাবাসীর যৌক্তিক দাবিকে আমরা সমর্থন করি।”

স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, ভাঙ্গা অঞ্চলের মানুষ মনে করেন, তাদের সীমানা পরিবর্তন করা হলে স্থানীয় পরিচিতি, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং রাজনৈতিক অধিকার ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তারা আশা করেন, প্রশাসন তাদের দাবি মেনে চলে পুনর্বিন্যাসের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করবে।

পুলিশি তৎপরতা ও প্রশাসনের পদক্ষেপ

ভাঙ্গা হাইওয়ে থানার পুলিশ ও হাইওয়ে পুলিশ অবরোধ স্থলে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। তবে বিপুলসংখ্যক অবরোধকারীর কারণে যান চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। জরুরি কিছু যানবাহন ছাড়া সমস্ত যানবাহন আটকা পড়ে।

ভাঙ্গা হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রোকিবুজ্জামান বলেন, “মহাসড়ক সবদিক থেকে বন্ধ থাকায় চারদিকেই যানজট হয়েছে। রাস্তার মধ্যে গাছের গুঁড়ি ফেলা থাকায় পুলিশের গাড়িও চলতে পারছে না। আমরা চেষ্টা করছি অবরোধ সরাতে, কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোনো ফল পাওয়া যায়নি।”

রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব

ফরিদপুর-৪ ও ফরিদপুর-২ আসনের সীমানা পরিবর্তনের বিষয়টি শুধু প্রশাসনিক নয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। ভাঙ্গা উপজেলার আলগী ও হামিরদী ইউনিয়ন সরাসরি এই সীমানা পরিবর্তনের প্রভাবের মুখোমুখি।

স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এমন পরিবর্তন এলাকায় রাজনৈতিক দখল এবং ভোটাধিকার ব্যবস্থার উপর প্রভাব ফেলতে পারে। নির্বাচনের আগে সীমানা পরিবর্তন করলে জনগণ বিভ্রান্ত হতে পারে এবং ভোটে অংশগ্রহণ কমতে পারে।

সামাজিক দিক থেকে, ভাঙ্গার মানুষ তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয় রক্ষা করতে চান। তারা মনে করেন, ভাঙ্গা উপজেলার মানুষের ঐতিহ্য, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্পগুলো ঠিকমতো পরিচালনা করতে হলে তাদের সংহত থাকা জরুরি।

দেশের অন্যান্য অঞ্চলের প্রভাব

ফরিদপুরের এই অবরোধ দেশের অন্যান্য দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা যেমন রাজবাড়ি, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, বরিশাল, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী এবং ভোলা পর্যন্ত প্রভাব ফেলেছে। মহাসড়ক অবরোধের কারণে এই এলাকার সঙ্গে ঢাকার সরাসরি সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে মালবাহী ট্রাক, যাত্রীবাহী বাস, এবং জরুরি পরিবহন পরিষেবা ব্যাহত হয়।

সড়ক নিরাপত্তা ও জরুরি পরিষেবা

বেশিরভাগ যাত্রী জরুরি সময়ে হেঁটে অথবা বিকল্প রুট ব্যবহার করে গন্তব্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করেন। চিকিৎসা, শিক্ষা ও ব্যবসায়িক কার্যক্রমের উপর এই অবরোধের প্রভাব পড়েছে। বিশেষত, জরুরি চিকিৎসা সেবা পেতে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন রোগীরা।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও সম্ভাব্য সমাধান

স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ অবরোধকারীদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছেন। বিশ্লেষকরা মনে করেন, যদি প্রশাসন দ্রুত কার্যকর সমাধান না বের করতে পারে, তাহলে আগামী দিনে আরও দীর্ঘ সময়ের জন্য যানজট এবং সামাজিক অস্থিরতা দেখা দিতে পারে।

অবস্থান নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি প্রশাসন আরও কার্যকর নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং জরুরি যানবাহনের চলাচলের জন্য ভিন্ন ভিন্ন রুট ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা করছে।

পাঠকদের জন্য পরামর্শ

যাত্রীরা অবরোধকৃত এলাকায় যাতায়াত করার আগে স্থানীয় সংবাদ এবং পুলিশের নির্দেশনা মেনে চলা উচিত। এছাড়া বিকল্প রুট এবং পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী যাতায়াত করলে ভোগান্তি কমানো সম্ভব।

MAH – 12715,  Signalbd.com

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button