বিশ্ব

যুদ্ধবিধ্বস্ত মিয়ানমারের মানুষদের দুর্দশা: অবৈধ পথে মালয়েশিয়ায় পাড়ি

Advertisement

দীর্ঘদিন ধরে গৃহযুদ্ধের কবলে থাকা মিয়ানমারের সাধারণ মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে সীমান্ত পেরিয়ে চলে যাচ্ছে বিভিন্ন দেশে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি মালয়েশিয়া অনেকদিন ধরেই এই শরণার্থীদের প্রধান গন্তব্য। তবে অনেকেই বৈধ কাগজপত্র ছাড়াই অবৈধভাবে পাড়ি জমাচ্ছেন দেশটিতে, যার ফলশ্রুতিতে তারা জড়িয়ে পড়ছেন অবৈধ কর্মকাণ্ডে।

সাম্প্রতিক একটি ঘটনায় মালয়েশিয়ার জোহর প্রদেশে অবৈধ বিনোদনকেন্দ্রের বিরুদ্ধে অভিযানে মিয়ানমারের ৮৩ নাগরিককে আটক করেছে পুলিশ। আটককৃতদের মধ্যে রয়েছে বিনোদনকেন্দ্রের কর্মী, হোস্টেস এমনকি গ্রাহকরাও।

জোহরে বড় পুলিশ অভিযান: আটকে ৮৩ মিয়ানমার নাগরিক

স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, গত ৩০ ও ৩১ আগস্ট পরপর দুইদিনে একযোগে অভিযান চালানো হয়। অভিযানে নেতৃত্ব দেয় জোহর ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট। রাজ্য পুলিশের প্রধান সিপি দাতুক কামারুল জামান মামাত গণমাধ্যমকে জানান:

“অভিযানে আমরা ৮টি বিনোদনকেন্দ্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি। এসব স্থানে বৈধ লাইসেন্স ছাড়াই ব্যবসা পরিচালনা করা হচ্ছিল এবং অনুমতি ছাড়া বিদেশি শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।”

অভিযানে আটককৃতদের বয়স ২২ থেকে ৪৭ বছরের মধ্যে। তাঁদের মধ্যে ৪৭ জন পুরুষ এবং ৩৬ জন নারী।

আটককৃতদের ভূমিকা: কারা ছিল হোস্টেস, কারা ছিল গ্রাহক?

পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, আটক ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছে—
✔ ৯ জন পরিচর্যাকারী
✔ ২৯ জন হোস্টেস
✔ ১ জন রাঁধুনি
✔ ৪৪ জন গ্রাহক

এদের বেশিরভাগের কাছেই বৈধ ভ্রমণ নথি ছিল না। ফলে তাদের বিরুদ্ধে ইমিগ্রেশন অ্যাক্ট ১৯৫৯/৬৩ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

কীভাবে চলছিল অবৈধ ব্যবসা?

অভিযানে জব্দ করা হয়েছে হিসাবের খাতা, বিক্রির রসিদ, মোবাইল ফোন, ট্যাবলেট এবং ৫ হাজার ৮৮ রিঙ্গিত নগদ অর্থ। তদন্তকারীরা বলছেন, এসব বিনোদনকেন্দ্র লাইসেন্সবিহীন ব্যবসা চালিয়ে আসছিল। শুধু তাই নয়, বিদেশি শ্রমিক নিয়োগেও কোনো অনুমতি নেওয়া হয়নি।

পুলিশ জানিয়েছে, এইসব কেন্দ্রগুলো শুধু অবৈধ মদ বিক্রি বা বিনোদন নয়, বরং মানবপাচার ও যৌন ব্যবসার সঙ্গেও জড়িত থাকতে পারে।

কোন আইনে মামলা হচ্ছে?

এই ঘটনায় কয়েকটি আইনের অধীনে মামলা হয়েছে, যেমন—
Johor Entertainment & Places of Entertainment Enactment, 1998
Johor Bahru City Council Trade, Business & Industrial License By Laws, 2016
Local Government Act, 1976
Immigration Act, 1959/63

এই আইনগুলো অনুযায়ী, মালয়েশিয়ায় অবৈধ বিনোদনকেন্দ্র চালানো এবং অনুমতি ছাড়া বিদেশি নিয়োগ কঠোর অপরাধ।

কেন মিয়ানমারের নাগরিকরা মালয়েশিয়ায় অবৈধ পথে আসছে?

মিয়ানমার গত কয়েক বছর ধরে গৃহযুদ্ধ ও সামরিক শাসনের কারণে অস্থিতিশীল। দেশটিতে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন দমন করতে সেনাবাহিনী ব্যাপক সহিংসতা চালাচ্ছে। ফলে লাখ লাখ মানুষ শরণার্থী হিসেবে দেশ ছাড়ছে।

তাদের অনেকেই মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরের মতো দেশে পাড়ি জমাচ্ছেন কাজের সন্ধানে। কিন্তু বৈধ উপায়ে কাজের অনুমতি পাওয়া কঠিন হওয়ায় অনেকে পাচারকারীদের মাধ্যমে অবৈধভাবে প্রবেশ করছেন।

মানবপাচার ও অবৈধ কর্মসংস্থানের চক্র

অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মালয়েশিয়ায় অবৈধ শ্রমিকদের বেশিরভাগই পাচার চক্রের মাধ্যমে প্রবেশ করে। পাচারকারীরা তাদের চাকরির প্রতিশ্রুতি দেয়, কিন্তু বাস্তবে তাদের বাধ্য করা হয় অবৈধ কাজে, যেমন—
✔ বিনোদনকেন্দ্রে কাজ
✔ যৌন ব্যবসা
✔ অবৈধ নির্মাণকাজ

এই কারণে অনেক মিয়ানমার নাগরিক অপরাধ চক্রের ফাঁদে পড়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হচ্ছেন।

পুলিশের অবস্থান: জিরো টলারেন্স

রাজ্য পুলিশের প্রধান কামারুল জামান স্পষ্ট করে বলেন:

“বিদেশিদের অবৈধ কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। এ ধরনের কার্যক্রমের খবর পেলে আমাদের হটলাইনে যোগাযোগ করতে সবাইকে অনুরোধ করছি।”

এছাড়া, তিনি জানিয়েছেন যে জোহর প্রদেশে অবৈধভাবে বসবাসকারী ও কাজ করা বিদেশিদের বিরুদ্ধে অভিযান আরও জোরদার করা হবে।

মালয়েশিয়ায় অভিবাসন সংকট: বড় চ্যালেঞ্জ

মালয়েশিয়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম শিল্পোন্নত দেশ হওয়ায় প্রতিবছর লাখ লাখ বিদেশি কর্মী আসে। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মালয়েশিয়ায় বর্তমানে প্রায় ২০ লাখের বেশি নিবন্ধিত বিদেশি শ্রমিক রয়েছে। তবে অবৈধ অভিবাসীর সংখ্যা অনুমান করা হয় ৩০ লাখের বেশি

মালয়েশিয়ার অর্থনীতি বিদেশি শ্রমিকের ওপর নির্ভরশীল হলেও অবৈধ অভিবাসীদের কারণে দেশটি নিরাপত্তা, অপরাধ এবং মানবপাচারের ঝুঁকিতে রয়েছে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও মানবাধিকার উদ্বেগ

জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থা (IOM) এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো মালয়েশিয়াকে আহ্বান জানিয়েছে যেন তারা আটক বিদেশিদের মানবিক আচরণের মাধ্যমে দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করে। একইসঙ্গে মিয়ানমারের রাজনৈতিক সংকট সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ানোরও আহ্বান জানানো হয়েছে।

সামনের দিনগুলোতে কী হবে?

পুলিশের ঘোষণা অনুযায়ী, জোহরসহ মালয়েশিয়ার অন্যান্য প্রদেশে অবৈধ বিনোদনকেন্দ্র ও অভিবাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান চলবে। অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মিয়ানমারে চলমান যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই সংকট আরও গভীর হবে।

MAH – 12621,  Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button