যশোরের কৃষকদের মুখে হাসি: পাট চাষে রেকর্ড ফলন ও ভালো দাম

পাটের সোনালি দিন ফিরে এসেছে
বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী ফসল পাট আবারও কৃষকের মুখে হাসি ফোটাচ্ছে। যশোর জেলার বিভিন্ন উপজেলায় পাট চাষে এ বছর ফলন ভালো হয়েছে, সাথে বাজারেও রয়েছে চমকপ্রদ দাম। কৃষকরা বলছেন, এবার পাট চাষ করে তারা লাভের মুখ দেখছেন। শুধু পাট নয়, পাটকাঠিও বিক্রি হচ্ছে ভালো দামে।
যশোরের কৃষকের গল্প: শেখ রাসেল উদ্দীনের সাফল্য
মনিরামপুর উপজেলার ভোজগাতী গ্রামের কৃষক শেখ রাসেল উদ্দীন গত বছর ২.৫ বিঘা জমিতে পাট চাষ করে পেয়েছিলেন ৩২ মণ পাট। সেবার তিনি পাটের দাম পান প্রতি মণ ৩১০০ টাকা। এ বছরও তিনি সমান জমিতে পাট চাষ করেছেন এবং খরচ হয়েছে প্রায় ৪২ হাজার টাকা।
এখন পর্যন্ত শুধুমাত্র পাটকাঠি বিক্রি করে তিনি পেয়েছেন ৩৭ হাজার টাকা। পাটের ফলন হয়েছে ৩১ মণ। বর্তমানে বাজারে প্রতি মণ পাট বিক্রি হচ্ছে ৩,৩০০ থেকে ৩,৯০০ টাকা দরে। যদি তিনি এখন বিক্রি করেন, তাহলে আয় হবে প্রায় ১ লাখ টাকার বেশি।
রাসেল উদ্দীন বলেন,
“এবার ফলন ভালো হয়েছে। বাজারে দামও ভালো। আমি আশা করছি দাম আরও বাড়বে, তাই শুকিয়ে রেখে পরে বিক্রি করব। পাটের পাশাপাশি পাটকাঠির দাম পেয়ে আমি খুব খুশি।”
পাটের ভালো দাম, কৃষকদের আনন্দ
যশোরের বাঘারপাড়া, মনিরামপুর, সদরসহ বিভিন্ন অঞ্চলে পাট চাষিদের মুখে হাসি। মৌসুমের শুরুতে খরা থাকায় কৃষকদের সেচ দিতে হয়েছিল। কিন্তু পরে পর্যাপ্ত বৃষ্টি হওয়ায় পাটগাছের বৃদ্ধি হয়েছে ভালো।
পাট কাটার সময় বেশি বৃষ্টি হওয়ায় জাগ দেওয়ার সুবিধা পেয়েছেন কৃষকরা। অধিকাংশ কৃষক কাছের জলাশয়ে পাট জাগ দিতে পেরেছেন। এতে পরিবহন খরচও কমেছে।
বর্তমানে বাজার দর:
- পাটের দাম: প্রতি মণ ৩,৩০০ – ৩,৯০০ টাকা
- পাটকাঠির দাম: প্রতি আঁটি ৩০ – ৪০ টাকা
অন্য কৃষকদের অভিজ্ঞতা
বাঘারপাড়া উপজেলার দোহাকুলা গ্রামের কৃষক ইকবাল কবির জানান, এ বছর ৮৮ শতক জমিতে পাট চাষ করে পেয়েছেন ৩০ মণ পাট। পাটকাঠি বিক্রি করে তিনি পেয়েছেন ২৬ হাজার টাকা।
তিনি বলেন,
“নদীতে পাট জাগ দিয়েছিলাম, তাই মান ভালো হয়েছে। বাজারে ভালো মানের পাটের দাম ৩,৮০০ – ৩,৯০০ টাকা। এবার সব খরচ বাদে লাভ হবে অনেক।”
পাট চাষের পরিসংখ্যান (যশোর জেলা)
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত তিন বছরের পাট চাষের পরিস্থিতি ছিল এ রকম:
- ২০২৩ সালে: লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৪,০০০ হেক্টর, চাষ হয়েছিল ২৫,৪০০ হেক্টরে।
- ২০২৪ সালে: লক্ষ্যমাত্রা ২৫,০০০ হেক্টর, চাষ হয়েছিল ২৩,৫৫০ হেক্টরে।
- ২০২৫ সালে: লক্ষ্যমাত্রা ২৪,২২০ হেক্টর, চাষ হয়েছে ২৪,৩৪০ হেক্টরে।
এ বছর যশোরের মোট পাট চাষের জমি:
- সদর উপজেলা: ১,৭২০ হেক্টর
- শার্শা: ৪,৯৬০ হেক্টর
- ঝিকরগাছা: ৩,৪৪০ হেক্টর
- চৌগাছা: ১,৬৫০ হেক্টর
- অভয়নগর: ২৫ হেক্টর
- বাঘারপাড়া: ১,৬২০ হেক্টর
- মনিরামপুর: ৪,৮৫৫ হেক্টর
- কেশবপুর: ৬,০৭০ হেক্টর
পাট চাষে সাফল্যের কারণ
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. মোশাররফ হোসেন জানান,
“এ বছর পর্যাপ্ত বৃষ্টি হয়েছে। ফলে পাটের মান ভালো হয়েছে। পাট জাগ দেওয়া সহজ হয়েছে। কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন। মৌসুমের শুরু থেকেই দামও ভালো।”
পাট শিল্পের সম্ভাবনা
বাংলাদেশে পাটকে বলা হয় ‘সোনালি আঁশ’। এক সময় বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের পাটের সুনাম ছিল অসামান্য। সাম্প্রতিক সময়ে আবারও সেই সোনালি দিন ফিরছে। পরিবেশবান্ধব পণ্য হিসেবে পাটের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। বর্তমানে পাট থেকে তৈরি করা হচ্ছে ব্যাগ, কার্পেট, শাড়ি, কাপড়, এমনকি গাড়ির ইন্টেরিয়র সামগ্রীও।
পাট রপ্তানি:
- ২০২৪ সালে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৮ লাখ টন পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে।
- প্রধান রপ্তানি বাজার: ভারত, চীন, তুরস্ক, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ।
কৃষকদের জন্য বিশেষ পরামর্শ
- উন্নত জাতের পাটের বীজ ব্যবহার করুন।
- খরা মৌসুমে সেচ দিন।
- পাট জাগের জন্য নদী বা পুকুর ব্যবহার করলে মান ভালো হয়।
- আঁশ শুকানোর সময় বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচাতে শেডের ব্যবস্থা করুন।
যশোরের কৃষকদের মতো দেশের অন্যান্য অঞ্চলের কৃষকরা যদি আধুনিক পদ্ধতিতে পাট চাষ করেন এবং সরকারি সহযোগিতা পান, তবে পাট আবার বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সোনালি অধ্যায় রচনা করবে।
MAH – 12580, Signalbd.com