
কুমিল্লার সদর দক্ষিণ উপজেলার রামনগর এলাকায় মর্মান্তিক ঘটনার সৃষ্টি হয়েছে। এক যুবকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে নিজের মা ও বোনকে কুপিয়ে হত্যার। পুলিশ ইতোমধ্যে ওই যুবক শাহীন (৩৫) ও তার স্ত্রী লাকি আক্তারকে আটক করেছে। রবিবার (৩১ আগস্ট) বিকেলের দিকে এই ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেন— লুৎফা বেগম (৭০) ও তার মেয়ে শিল্পী আক্তার (৪০)।
ঘটনার বিস্তারিত
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, দুপুরের পর এলাকাবাসী হঠাৎ বাড়ি থেকে কান্নার শব্দ শুনে এগিয়ে যান। পরে তারা ঘরে ঢুকে দেখেন, লুৎফা বেগম ও শিল্পী আক্তার রক্তাক্ত অবস্থায় খাটের ওপর পড়ে আছেন। দ্রুত পুলিশে খবর দেওয়া হলে সদর দক্ষিণ থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে মরদেহ উদ্ধার করে।
অভিযোগ উঠেছে, পারিবারিক কলহের জের ধরেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। নিহতদের আরেক মেয়ে শিউলি আক্তার দাবি করেছেন, তার ভাই শাহীন ও ভাবি লাকি প্রায়ই তাদের মা ও বোনকে নির্যাতন করত। শনিবারও তাদের সঙ্গে ঝগড়া হয়েছিল। রবিবার দুপুরে স্থানীয়রা প্রথমে বিষয়টি টের পান এবং পরে পুলিশে খবর দেন।
প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য
অভিযুক্তের চাচাতো ভাই জসিম উদ্দিন জানান, দুপুরে শাহীন ফোন করে জানায় তার মা ও বোন মারা গেছেন। খবর শুনে তিনি দ্রুত বাড়িতে যান। সেখানে গিয়ে দেখেন, দুজনকেই ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তিনি বলেন, “ঘরে ঢুকে যে দৃশ্য দেখেছি তা কখনো ভুলতে পারব না। রক্তে ভেসে যাচ্ছিল খাট আর মেঝে।”
পুলিশি তদন্ত ও আইনগত ব্যবস্থা
কুমিল্লা ইপিজেড পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ সাইফুল ইসলাম জানিয়েছেন, মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে হত্যার কাজে ব্যবহৃত ধারালো অস্ত্র জব্দ করা হয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আটক শাহীন ও তার স্ত্রী হত্যার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। তবে তদন্ত কর্মকর্তাদের ধারণা, পারিবারিক বিরোধই হত্যাকাণ্ডের মূল কারণ।
তিনি আরও বলেন, “এটি একটি নৃশংস হত্যাকাণ্ড। তদন্ত শেষ হলে প্রকৃত সত্য সবার সামনে আসবে। বর্তমানে দুই আসামিকে থানায় রেখে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।”
নিহত পরিবারের পরিচয়
স্থানীয়রা জানান, নিহত লুৎফা বেগম ছিলেন এলাকার সবার কাছে পরোপকারী ও দয়ালু নারী। স্বামী আবু তাহের মৃত্যুর পর তিনি সন্তানদের নিয়েই সংসার চালাচ্ছিলেন। বড় মেয়ে শিল্পী আক্তার স্থানীয় একটি স্কুলে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করতেন। তাদের মৃত্যুতে পুরো এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
প্রতিবেশীরা বলছেন, শাহীনের সঙ্গে তার মা ও বোনের সম্পর্ক ভালো ছিল না। প্রায়ই জমিজমা ও আর্থিক বিষয় নিয়ে ঝগড়া হতো। সেই বিরোধই হয়তো এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে কাজ করেছে।
স্থানীয়দের প্রতিক্রিয়া
এলাকাবাসীর দাবি, শাহীনের বিরুদ্ধে আগে থেকেই নানা অভিযোগ ছিল। তিনি প্রায়ই মাদকাসক্ত অবস্থায় বাড়ি ফিরতেন এবং পরিবারের সদস্যদের মারধর করতেন। স্থানীয়রা বারবার তাকে সাবধান করলেও কোনো লাভ হয়নি। হত্যাকাণ্ডের পর সবাই হতবাক হয়ে পড়েছেন।
প্রতিবেশী আজিজুল হক বলেন, “আমরা অনেকবার ওদের পরিবারে ঝগড়াঝাঁটি থামাতে গিয়েছি। কিন্তু আজ যা হলো, তা অকল্পনীয়।”
দেশে পারিবারিক সহিংসতার ভয়াবহতা
সাম্প্রতিক সময়ে দেশে পারিবারিক কলহ ও সহিংসতার কারণে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বেড়েছে। বাংলাদেশ পুলিশ সদর দপ্তরের সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, পারিবারিক বিরোধ থেকে সংঘটিত হত্যার সংখ্যা প্রতি বছরই বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আর্থিক সংকট, মাদকাসক্তি, সামাজিক অবক্ষয় ও মানসিক অস্থিরতা এসব ঘটনার বড় কারণ।
এমন মর্মান্তিক ঘটনার ফলে প্রশ্ন উঠছে—পারিবারিক সমস্যা সমাধানে কি আমরা যথেষ্ট সচেতন? আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মনে করে, সামাজিক সচেতনতা এবং পারিবারিক বন্ধন মজবুত করাই এ ধরনের অপরাধ ঠেকানোর মূল উপায়।
বিশেষজ্ঞ মতামত
অপরাধ বিশ্লেষকরা মনে করেন, পারিবারিক সমস্যাগুলো গুরুত্ব সহকারে না নিলে তা ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে। সমাজবিজ্ঞানী ড. মাহবুবা হোসেন বলেন, “প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের পেছনে দীর্ঘদিনের মানসিক চাপ ও বিরোধ জমে থাকে। যদি আগে থেকে সমাধান করা যেত, অনেক জীবন বাঁচানো সম্ভব হতো।”
কুমিল্লার রামনগরে মা ও বোনকে কুপিয়ে হত্যার এই নৃশংস ঘটনা শুধু একটি পরিবারকে নয়, পুরো সমাজকেই নাড়িয়ে দিয়েছে। পরিবারের ভেতরের কলহ কীভাবে ভয়ঙ্কর রূপ নিতে পারে, তার স্পষ্ট উদাহরণ এটি। পুলিশ তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত সত্য প্রকাশ করবে। তবে এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে পরিবার ও সমাজকে আরও সচেতন হতে হবে। প্রশ্ন থেকে যায়—পরিবারের ভেতরকার এই বিভাজন ও সহিংসতা কতদিনে কমবে?
এম আর এম – ১১১৩, Signalbd.com