একজন ইসরায়েলির বদলে ৫০ জন ফিলিস্তিনিকে মরতে হবে: সাবেক ইসরায়েলি গোয়েন্দা প্রধান

ইসরায়েলের সাবেক সামরিক গোয়েন্দা প্রধান মেজর জেনারেল আহারন হালিভার একটি ফাঁস হওয়া অডিও রেকর্ডিং আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছে। সেখানে তাকে বলতে শোনা যায়, “৭ অক্টোবর হামাসের আক্রমণে নিহত প্রত্যেক ইসরায়েলির বদলে ৫০ জন ফিলিস্তিনিকে মরতে হবে।” এই বক্তব্য শুধু মানবাধিকার মহলেই নয়, বিশ্বজুড়ে তীব্র সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
হালিভার বক্তব্য ও অডিও রেকর্ডিং প্রকাশ
ইসরায়েলের জনপ্রিয় চ্যানেল ১২ সম্প্রতি একটি অডিও রেকর্ডিং প্রচার করে। সেখানে হালিভাকে স্পষ্টভাবে বলতে শোনা যায় যে, গাজায় ফিলিস্তিনিদের ব্যাপক মৃত্যুকে তিনি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অপরিহার্য মনে করেন। তিনি বলেন, “গাজায় ইতোমধ্যেই হাজারো মানুষ নিহত হয়েছে, কিন্তু এটি যথেষ্ট নয়। একজন ইসরায়েলির জন্য ৫০ জন ফিলিস্তিনিকে মরতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “এটি প্রতিশোধের জন্য নয়, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য শিক্ষা হিসেবে দরকার। মাঝে মাঝে তাদের নাকবার মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে, যাতে তারা বুঝতে পারে পরিণতি কত ভয়াবহ।”
নাকবার প্রসঙ্গ ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
হালিভার বক্তব্যে উল্লেখিত “নাকবা” শব্দটি ফিলিস্তিনি জনগণের কাছে বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় প্রায় সাত লাখ ফিলিস্তিনিকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল। সেই ঘটনাকেই তারা “নাকবা” বা মহাবিপর্যয় নামে অভিহিত করে। হালিভা ইঙ্গিত দিয়েছেন, ফিলিস্তিনিদের বারবার এমন অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হবে যাতে তারা তাদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ে।
৭ অক্টোবর হামাসের আক্রমণ ও পরবর্তী পরিস্থিতি
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজার দিক থেকে হামাস ইসরায়েলে বড় ধরনের আক্রমণ চালায়। ওই ঘটনায় প্রায় ১ হাজার ২০০ ইসরায়েলি নিহত হয় এবং অন্তত ২৫০ জনকে বন্দি করে নিয়ে যায়। এ হামলার জন্য গোয়েন্দা তথ্য দিতে ব্যর্থ হওয়ায় সমালোচনার মুখে হালিভা ২০২৪ সালের এপ্রিলে পদত্যাগ করেন। তিনি ছিলেন প্রথম উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তা, যিনি ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে পদত্যাগ করেন।
গাজার মৃত্যু ও ধ্বংসযজ্ঞের চিত্র
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত ইসরায়েলি অভিযানে ৬১ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। নিহতদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ নারী ও শিশু। একই সঙ্গে প্রায় ২৩ লাখ মানুষ একাধিকবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো একে গণহত্যার সঙ্গে তুলনা করছে।
হালিভার বক্তব্য আরও স্পষ্ট করে যে, এই হত্যাযজ্ঞ কোনো দুর্ঘটনা নয়, বরং পরিকল্পিত ও নীতিগত সিদ্ধান্তের ফল।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও সমালোচনা
হালিভার বক্তব্য প্রকাশের পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের বক্তব্য প্রমাণ করে ইসরায়েলের শীর্ষ নেতৃত্ব গণহত্যার নীতি মেনে চলেছে। নিউজিল্যান্ড ও ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রীরা প্রকাশ্যে নেতানিয়াহুর নীতি সমালোচনা করেছেন। তাদের ভাষায়, গাজা দখল ও নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য।
হামাসও এক বিবৃতিতে বলেছে, এই অডিও প্রমাণ করে যে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে অপরাধ ইসরায়েলের রাষ্ট্রীয় নীতি। তাদের মতে, এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনার ফল নয়, বরং দীর্ঘদিন ধরে পরিকল্পিত আগ্রাসনের বহিঃপ্রকাশ।
ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও উদ্দেশ্য
অডিওতে হালিভাকে আরও বলতে শোনা যায় যে, ইসরায়েল সচেতনভাবেই পশ্চিম তীরে অস্থিতিশীলতা বাড়াতে চায়। এতে হামাস যদি সেখানে প্রভাব বিস্তার করে, তবে আন্তর্জাতিক মহল ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে আলোচনায় রাজি হবে না। ফলে দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের পথও বন্ধ হয়ে যাবে।
তিনি আরও দাবি করেন, ইসরায়েলের কিছু নীতিনির্ধারক হামাসকে কার্যত প্রয়োজনীয় মনে করে। কারণ ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের আন্তর্জাতিক বৈধতা থাকলেও হামাসের নেই। তাই তাদের বিরুদ্ধে অবাধে সামরিক অভিযান চালানো সহজ হয়।
বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকার সংস্থার দৃষ্টিভঙ্গি
মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, হালিভার বক্তব্য কেবল রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নয়, এটি আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের স্পষ্ট প্রমাণ। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (ICC) ইতোমধ্যেই গাজায় ইসরায়েলি হামলাকে তদন্তের আওতায় নিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইসরায়েলের এই নীতি অব্যাহত থাকলে মধ্যপ্রাচ্যে সহিংসতা আরও বাড়বে এবং শান্তির সম্ভাবনা ধ্বংস হবে।
সংক্ষিপ্তসার
আহারন হালিভার এই বক্তব্য শুধু ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্ব নয়, বরং সমগ্র বিশ্বকে নাড়া দিয়েছে। একজন সাবেক গোয়েন্দা প্রধান প্রকাশ্যে স্বীকার করছেন, ফিলিস্তিনিদের জীবনকে তুচ্ছ জেনে তাদের উপর পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞ চালানো হচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে—এত মৃত্যু ও ধ্বংসের পরও কি শান্তি প্রতিষ্ঠার কোনো সুযোগ আছে? নাকি ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আরও রক্তাক্ত ইতিহাসের সাক্ষী হতে চলেছে?
এম আর এম – ০৯১৬, Signalbd.com