
বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মকে বিশ্বমানের শিল্প-সংশ্লিষ্ট দক্ষতায় প্রস্তুত করার ওপর জোর দিয়েছেন শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সি আর আবরার। তিনি বলেছেন, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ (টিভিইটি) খাতকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা ছাড়া দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি সম্ভব নয়।
তিনি আরও বলেন, “সেবা খাতে দক্ষ টিভিইটি স্নাতকদের চাহিদা দ্রুত বাড়ছে। আমাদের তরুণদের এখনই এমন দক্ষতা অর্জন করতে হবে, যা শুধু দেশের ভেতরে নয়, বৈশ্বিক চাকরির বাজারেও প্রতিযোগিতামূলক করে তুলবে।”
টিভিইটি বাস্তবায়ন পরিকল্পনা ২০২৫-২০৩০: এক নতুন মাইলফলক
রোববার (১০ আগস্ট) রাজধানীর একটি পাঁচতারকা হোটেলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি শিক্ষা অধিদফতরের উদ্যোগে আয়োজিত “টিভিইটি বাস্তবায়ন পরিকল্পনা ২০২৫-২০৩০” উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শিক্ষা উপদেষ্টা প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন।
এই পরিকল্পনা প্রণয়নে প্রায় দুই বছরের গবেষণা, মাঠপর্যায়ের পরামর্শ ও দেশের বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের মতামত অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পরিকল্পনাটি বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাজেট ভিত্তিক জাতীয় রোডম্যাপ, যা ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)-এর অর্থায়নে পরিচালিত এইচসিডিপি-২১ বাজেট সাপোর্ট প্রোগ্রাম এর সহায়তায় বাস্তবায়িত হবে।
৬টি প্রধান ক্ষেত্র ও ৮৭টি কৌশলগত পদক্ষেপ
পরিকল্পনায় মোট ৬টি প্রধান ফলাফল ক্ষেত্র নির্ধারণ করা হয়েছে—
- প্রশিক্ষণের মান উন্নয়ন
- প্রশিক্ষণের প্রাসঙ্গিকতা নিশ্চিতকরণ
- দক্ষতার সহজ প্রবেশাধিকার বৃদ্ধি
- সিস্টেম উন্নয়ন
- প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি
- শিল্প-শিক্ষা সংযোগ ও অর্থায়ন শক্তিশালীকরণ
এছাড়া, এই ক্ষেত্রগুলোর অধীনে মোট ৮৭টি কৌশলগত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে, যা প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি, ও বাজারমুখী দক্ষতা গঠনে বড় ভূমিকা রাখবে।
বাংলাদেশে টিভিইটি খাতের বর্তমান অবস্থা
বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৪,০০০-এর বেশি কারিগরি ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে প্রতিবছর প্রায় ১২-১৫ লাখ শিক্ষার্থী ভর্তি হলেও, প্রশিক্ষণ শেষে আন্তর্জাতিক মানের সনদ ও দক্ষতার ঘাটতির কারণে অনেকেই উপযুক্ত কর্মসংস্থান পান না।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশের শ্রমশক্তির প্রায় ৮৫% অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত, যেখানে দক্ষতা উন্নয়নের সুযোগ সীমিত। ফলে বিদেশে প্রবাসী শ্রমিকদের অনেকেই স্বল্প মজুরির কাজে সীমাবদ্ধ থাকেন।
বিশ্ববাজারে দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) তথ্য অনুযায়ী, আগামী ৫ বছরে বিশ্বে দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা ২০% বৃদ্ধি পাবে। বিশেষত মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং ইউরোপে নবায়নযোগ্য জ্বালানি, তথ্যপ্রযুক্তি, স্বাস্থ্যসেবা, এবং উন্নত উৎপাদনশীল শিল্পে প্রশিক্ষিত কর্মীর প্রয়োজন হবে।
বাংলাদেশ যদি এখন থেকেই বিশ্বমানের প্রশিক্ষণ দিতে সক্ষম হয়, তাহলে প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে এবং অর্থনীতিতে নতুন গতি আসবে।
শিল্প-শিক্ষা সংযোগের গুরুত্ব
শিল্প মালিকদের সংগঠনগুলোর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার ওপরও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এই পরিকল্পনায়। কারণ, প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোতে যা শেখানো হয়, তা যেন সরাসরি শিল্পকারখানার বাস্তব প্রয়োজনে ব্যবহারযোগ্য হয়।
ড. আবরার বলেন—
“প্রশিক্ষণ কার্যক্রমকে শুধু সনদভিত্তিক না করে, বাস্তব কাজের অভিজ্ঞতা ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধির দিকে নজর দিতে হবে। এতে তরুণরা চাকরি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কাজের ক্ষেত্রেও কার্যকর হবে।”
সরকারি ও বেসরকারি খাতের সমন্বয় প্রয়োজন
টিভিইটি খাতের উন্নয়নে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি খাত ও এনজিওগুলোর অংশগ্রহণও অপরিহার্য। দেশের বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন, ইন্টার্নশিপ ও শিক্ষানবিশ কর্মসূচি চালু করার আহ্বান জানান শিক্ষা উপদেষ্টা।
এছাড়া, নারীদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালুর মাধ্যমে কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গ সমতা প্রতিষ্ঠা করার কথাও উল্লেখ করা হয়।
ডিজিটাল স্কিল ও ভবিষ্যৎ প্রযুক্তি
টিভিইটি পরিকল্পনায় ডিজিটাল দক্ষতা এবং ফিউচার স্কিলস-এর ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে।
যেমন—
- কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI)
- রোবোটিক্স
- ইন্টারনেট অব থিংস (IoT)
- সাইবার নিরাপত্তা
- গেম ডেভেলপমেন্ট
- গ্রাফিক ডিজাইন ও অ্যানিমেশন
এসব খাতে প্রশিক্ষণ নিয়ে তরুণরা আন্তর্জাতিক ফ্রিল্যান্সিং মার্কেট এবং বিদেশি প্রতিষ্ঠানে সহজেই কাজের সুযোগ পাবে।
বাংলাদেশের তরুণ জনগোষ্ঠী দেশের সবচেয়ে বড় শক্তি। কিন্তু এই শক্তিকে কাজে লাগাতে হলে তাদের দক্ষ ও বাজারমুখী করে তুলতে হবে। টিভিইটি বাস্তবায়ন পরিকল্পনা ২০২৫-২০৩০ সেই দিকেই একটি বড় পদক্ষেপ। যদি পরিকল্পনাটি সফলভাবে বাস্তবায়িত হয়, তবে বাংলাদেশ শুধু দেশীয় অর্থনীতিতেই নয়, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মানচিত্রেও আরও শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করবে।
MAH – 12248 , Signalbd.com