ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলার প্রেক্ষাপটে গাজা সিটিতে বসবাসকারী ফিলিস্তিনিরা এখন এক বিরাট মানবিক সংকটের মুখে পড়েছেন। গাজার বাসিন্দাদের অন্যত্র স্থানান্তরের ইসরায়েলি পরিকল্পনা নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাস। হামাসের অভিযোগ, এ ধরনের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে নতুন করে জাতিহত্যা (জেনোসাইড) সংঘটিত হবে এবং লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে।
হামাসের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “মানবিকতার আড়ালে তাঁবু এবং অন্যান্য সরঞ্জাম স্থাপন করাটা স্পষ্ট প্রতারণা। এটি দখলদার বাহিনী যে নৃশংস অপরাধের পরিকল্পনা করছে, তা লুকানোর কৌশল।”
ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ গতকাল রোববার জানিয়েছে, তাঁরা ত্রাণসামগ্রী, তাঁবু ও অন্যান্য সরঞ্জাম সরবরাহ শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এর লক্ষ্য হলো গাজার উত্তরের অঞ্চল থেকে স্থানীয় বাসিন্দাদের দক্ষিণাঞ্চলে স্থানান্তরিত করা, যেখানে তারা “নিরাপদ” অবস্থান করতে পারবে। ইসরায়েলের দাবি, এটি বাসিন্দাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য নেওয়া একটি মানবিক পদক্ষেপ।
কিন্তু হামাসের বক্তব্য স্পষ্ট – গাজার মানুষদের বাস্তুচ্যুত করা এবং তাদের নতুন এলাকায় বাধ্যতামূলকভাবে পাঠানো মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল। তারা সতর্ক করেছে, এ ধরনের পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হলে অঞ্চলটিতে আরও সহিংসতা এবং গণহত্যার ঝুঁকি বাড়বে।
উত্তর গাজার নিয়ন্ত্রণে ইসরায়েলের নতুন অভিযান
ইসরায়েল চলতি মাসের শুরুতে ঘোষণা দিয়েছে, তারা উত্তর গাজার নিয়ন্ত্রণ নিতে নতুন সামরিক অভিযান চালাবে। উত্তর গাজা সিটি গাজার বৃহত্তম নগরকেন্দ্র এবং এখানে প্রায় ২২ লাখ মানুষ বসবাস করে। এই অঞ্চলে সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের স্থানান্তরের পরিকল্পনা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
জাতিসংঘ এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা ইতিমধ্যেই সতর্ক করেছে, এ ধরনের পদক্ষেপ মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গের শামিল হতে পারে।
গাজার মানুষদের বাস্তবিক পরিস্থিতি
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের একটি হামলার পর ইসরায়েল গাজার দক্ষিণাঞ্চলে প্রতিশোধমূলক এবং নির্বিচার হামলা চালাতে শুরু করে। এ হামলায় সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ৬১,০০০-এর বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। শত শত হাজার মানুষ গাজার বিভিন্ন অংশ থেকে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় মানবাধিকার সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, আজও হাজার হাজার মানুষ ত্রাণ এবং নিরাপদ আশ্রয়ের অভাবে ভুগছেন। শহরের অবকাঠামোর বড় অংশ ধ্বংস হয়ে গেছে। হাসপাতাল, স্কুল, আবাসিক এলাকা এবং গুরুত্বপূর্ণ সেবাসমূহ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত।
ফিলিস্তিনি চিকিৎসকরা সতর্ক করেছেন, বর্তমান পরিস্থিতি একটি মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করছে। বিদ্যুৎ ও পানীয় জলের ঘাটতি, তীব্র খাদ্যসংকট, এবং চিকিৎসা সেবার অভাব দ্রুত সাধারণ মানুষের মৃত্যুর ঝুঁকি বৃদ্ধি করছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
গাজায় সাম্প্রতিক মানবিক সঙ্কট এবং স্থানান্তর পরিকল্পনা নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
- জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা বলেছে, “গাজার মানুষদের বাধ্যতামূলকভাবে স্থানান্তর করা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের পরিপন্থী।”
 - শতাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং মানবাধিকার সংস্থা ইসরায়েলকে ত্রাণ সরবরাহকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার না করার আহ্বান জানিয়েছে।
 - যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশও সতর্ক করেছে যে, এ ধরনের পদক্ষেপ অঞ্চলের স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে পারে।
 
বিশ্লেষকরা বলছেন, গাজার উত্তরের অভিযান এবং স্থানান্তরের পরিকল্পনা রাজনৈতিক উত্তেজনা আরও বাড়াবে, এবং এ অঞ্চলে নতুন মানবিক সংকটের জন্ম দিতে পারে।
গাজার বাস্তুচ্যুত মানুষের কষ্ট
গাজার বাসিন্দারা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য বিভিন্ন আশ্রয়শিবির এ আশ্রয় নিচ্ছেন। কিন্তু সেখানেও তাদের জীবন সহজ নয়।
- তাঁবু এবং সাময়িক আশ্রয়ে মানুষের সংখ্যা অতিরিক্ত বেড়ে গেছে।
 - পানীয় জল, খাবার এবং স্বাস্থ্যসেবা এখন সংকটে।
 - শিশু ও বৃদ্ধরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।
 
স্থানীয়রা জানান, ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের কারণে তারা দৈনন্দিন জীবন চালানোও অসম্ভব হয়ে পড়েছে। স্কুল বন্ধ, হাসপাতাল ক্ষতিগ্রস্ত, এবং সড়ক-মহাসড়ক ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় মানুষের চলাচল কঠিন হয়ে গেছে।
ভবিষ্যতের আশঙ্কা
বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, ইসরায়েলের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে নতুন ধরনের গণহত্যা এবং দারিদ্র্য সৃষ্টি হতে পারে। গাজার মানুষদের মানবিক অধিকার নিশ্চিত করতে তাত্ক্ষণিক আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ অপরিহার্য।
এছাড়াও, অনেক আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক মনে করছেন, ইসরায়েলের সামরিক অভিযান এবং হামাসের প্রতিহামলা এক চক্রাকার সহিংসতা সৃষ্টি করেছে, যা দ্রুত বন্ধ না করা গেলে মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করা কঠিন হবে।
গাজার মানুষদের জন্য বর্তমান পরিস্থিতি এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়। হামাস এবং ইসরায়েলের মধ্যে চলমান দ্বন্দ্বে সাধারণ মানুষদের নিরপরাধ জীবন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ইসরায়েলের পরিকল্পিত স্থানান্তর, হামাসের প্রতিক্রিয়া এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগের মধ্যে এ অঞ্চলে মানবিক সংকট আরও গভীর হচ্ছে।
গাজার মানুষদের নিরাপত্তা, খাদ্য, জল ও চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করার জন্য অন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তৎপরতা ও হস্তক্ষেপ এখন অতীব জরুরি।
MAH – 12389 , Signalbd.com
				
					


