ইসরায়েলের নতুন বসতি পরিকল্পনা: ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত

ইসরায়েলের কট্টরপন্থী অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোত্রিচ সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছেন—দখলকৃত পশ্চিম তীরে বিতর্কিত ‘ই-ওয়ান’ বসতি প্রকল্পের আওতায় ৩ হাজারের বেশি নতুন ঘর নির্মাণ করা হবে। তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী, এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে “স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ধারণার কবর রচিত হবে”।
এই ঘোষণাটি এসেছে এমন এক সময়, যখন আন্তর্জাতিক মহল—বিশেষ করে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া—ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। ইসরায়েল এর তীব্র বিরোধিতা করলেও, বসতি স্থাপনের এই ঘোষণা মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি প্রক্রিয়া নিয়ে নতুন করে আশঙ্কা সৃষ্টি করেছে।
ই-ওয়ান প্রকল্প কী?
‘ই-ওয়ান’ হলো পশ্চিম তীরের মালে আদুমিম বসতি ও পূর্ব জেরুজালেমের মধ্যবর্তী এলাকা। কয়েক দশক ধরে এই অঞ্চলে বড় আকারের বসতি গড়ে তোলার পরিকল্পনা থাকলেও, আন্তর্জাতিক বিরোধিতা ও চাপের মুখে প্রকল্পটি স্থগিত ছিল।
প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে:
- পূর্ব জেরুজালেম কার্যত পশ্চিম তীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।
- ফিলিস্তিনিদের জন্য পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে একীভূত রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
- ভূ-রাজনৈতিক মানচিত্রে পশ্চিম তীর দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যাবে, যা চলাচল ও প্রশাসন উভয় ক্ষেত্রেই প্রভাব ফেলবে।
স্মোত্রিচের বক্তব্য
স্মোত্রিচ সংবাদ সম্মেলনে বলেন:
“কয়েক দশকের আন্তর্জাতিক চাপ ও স্থগিতাদেশের পর আমরা প্রথা ভেঙে মালে আদুমিমকে জেরুজালেমের সঙ্গে যুক্ত করছি। এটাই জায়নবাদের সেরা রূপ—বাড়ি নির্মাণ, বসতি স্থাপন এবং ইসরায়েলের ভূমিতে আমাদের সার্বভৌমত্বকে শক্তিশালী করা।”
তাঁর দাবি—ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই, তাই স্বীকৃতি দেওয়ার মতো কিছুই আন্তর্জাতিক মহলের হাতে নেই।
আন্তর্জাতিক আইন ও বসতি ইস্যু
- জাতিসংঘসহ অধিকাংশ আন্তর্জাতিক সংস্থা দখলকৃত ভূমিতে ইসরায়েলি বসতিকে অবৈধ বলে মনে করে।
- চতুর্থ জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী, যুদ্ধের মাধ্যমে অধিকৃত ভূখণ্ডে দখলদার দেশের জনগণকে স্থানান্তর করা নিষিদ্ধ।
- ইসরায়েল এসব অভিযোগ অস্বীকার করে এবং বলে—এই ভূমি ঐতিহাসিকভাবে ইহুদিদের।
বর্তমান বসতির পরিসংখ্যান
মানবাধিকার সংগঠন পিস নাউ-এর তথ্যমতে:
- পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে প্রায় ১৬০টি ইসরায়েলি বসতি রয়েছে।
- এখানে প্রায় ৭ লাখ ইহুদি বাস করেন।
- এই জমিই ভবিষ্যৎ স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, যা ফিলিস্তিনিরা তাদের জাতীয় ভূখণ্ড হিসেবে দাবি করে।
প্রকল্প ঘোষণার পটভূমি
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে:
- যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া—ফিলিস্তিন রাষ্ট্র স্বীকৃতির পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে।
- ইসরায়েল এর বিরুদ্ধে কূটনৈতিক প্রতিবাদ জানিয়েছে।
- এই পরিস্থিতিতেই স্মোত্রিচ, ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের সংগঠন ইয়েশা কাউন্সিল এর চেয়ারম্যান ইসরায়েল গানৎজ এবং মালে আদুমিমের মেয়র গাই ইফ্রেচকে সঙ্গে নিয়ে এই বসতি পরিকল্পনার ঘোষণা দেন।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)
ইইউ এক বিবৃতিতে জানায়—ইসরায়েলের বসতি সম্প্রসারণ মধ্যপ্রাচ্যে দুই-রাষ্ট্র সমাধানের সম্ভাবনাকে হুমকির মুখে ফেলছে।
যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স
দুই দেশই আগেই বলেছে, তারা ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেবে—এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে সেই প্রক্রিয়া আরও ত্বরান্বিত হতে পারে।
জাতিসংঘ
জাতিসংঘের মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়ার বিশেষ দূত বলেছেন—এটি “শান্তি আলোচনা পুনরারম্ভের সব প্রচেষ্টা ধ্বংস করবে”।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
- ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরায়েল পশ্চিম তীর, গাজা, পূর্ব জেরুজালেম দখল করে।
- ইসরায়েল তখন থেকেই পূর্ব জেরুজালেমকে তাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ দাবি করে।
- কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় পূর্ব জেরুজালেমকে অধিকৃত অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
- বসতি স্থাপন দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের অন্যতম প্রধান ইস্যু।
সম্ভাব্য প্রভাব
- শান্তি প্রক্রিয়ার ভেঙে পড়া — নতুন বসতি স্থাপন ফিলিস্তিনিদের আলোচনায় আস্থাহীন করবে।
- ভূ-প্রকৌশলগত বিচ্ছিন্নতা — পশ্চিম তীর ভৌগোলিকভাবে বিভক্ত হয়ে ফিলিস্তিনিদের চলাচল সীমিত হবে।
- আঞ্চলিক উত্তেজনা বৃদ্ধি — প্রতিবেশী আরব রাষ্ট্রগুলো থেকে প্রতিবাদ এবং সম্ভাব্য সহিংসতা।
- আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতা — ইসরায়েল পশ্চিমা মিত্রদের মধ্যেও সমালোচনার মুখে পড়তে পারে।
ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি
- কট্টর ডানপন্থী জোট সরকার ক্ষমতায়।
- বসতি সম্প্রসারণ তাদের রাজনৈতিক অঙ্গীকারের অংশ।
- অভ্যন্তরীণ বিরোধী দল ও শান্তিপ্রিয় সংগঠনগুলো (যেমন “পিস নাউ”) এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে।
বিশ্লেষণ
বসতি স্থাপন ইস্যু শুধু ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত নয়; এটি আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক কূটনীতির কেন্দ্রবিন্দু। ‘ই-ওয়ান’ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে পূর্ব জেরুজালেম কার্যত ফিলিস্তিনের নাগালের বাইরে চলে যাবে, যা দুই-রাষ্ট্র সমাধানকে প্রায় অসম্ভব করে তুলবে।
অর্থমন্ত্রী স্মোত্রিচের উক্তি ইঙ্গিত দিচ্ছে—সরকার কোনো শান্তি চুক্তির জন্য বসতি থামাতে প্রস্তুত নয়। বরং তারা এটি সার্বভৌমত্ব জোরদারের প্রতীক হিসেবে দেখছে।
ইসরায়েলের ‘ই-ওয়ান’ প্রকল্পের ঘোষণা শুধু একটি অবকাঠামো পরিকল্পনা নয়; এটি মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি প্রক্রিয়ার ভবিষ্যৎ নির্ধারণকারী ঘটনা হতে পারে। ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ধারণা বাস্তবে রূপ পাবে কি না, তার উপর সরাসরি প্রভাব ফেলবে এই প্রকল্প। আন্তর্জাতিক চাপ ও সমালোচনা সত্ত্বেও ইসরায়েল যদি এই পথে এগোয়, তবে সংঘাত সমাধানের আশা আরও ক্ষীণ হয়ে পড়বে।
MAH – 12325 , Signalbd.com