সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় শিপিং কোম্পানি ‘বাহরি’র একটি জাহাজ, যার নাম ‘বাহরি ইয়ানবু’, ইসরায়েলের উদ্দেশ্যে অস্ত্র পরিবহনের অভিযোগে ইতালির জেনোয়া বন্দরের বন্দরকর্মীদের কঠোর প্রতিবাদের মুখে পড়ে। ৮ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড থেকে অস্ত্রসহ ইতালির জেনোয়া বন্দরে পৌঁছানো এই জাহাজটিতে অস্ত্র বোঝাইয়ের ক্ষেত্রে বন্দরকর্মীরা সুষ্ঠু তদারকি ও নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসেন। বন্দরকর্মীরা অস্ত্রবোঝাই করার জন্য জাহাজে প্রবেশের চেষ্টা করলেও তারা অস্ত্র পরিবহন বন্ধ করতে বাধা দেন এবং অস্ত্রবোঝাইয়ে সাফ অস্বীকৃতি জানান।
জাহাজ ও অস্ত্র বোঝাইয়ের বিস্তারিত ঘটনা
‘বাহরি ইয়ানবু’ নামের সৌদি জাহাজটি ৮ আগস্ট ইতালির জেনোয়া বন্দরে আসে। এই জাহাজে ইতালি ভিত্তিক অস্ত্র প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান লিওনার্দোর তৈরি সামরিক সরঞ্জাম বোঝাই হওয়ার কথা ছিল। অস্ত্রের মধ্যে ছিল আবুধাবির জন্য ওটো মেলারা কামান, সম্ভবত ট্যাঙ্কসহ অন্যান্য ভারি অস্ত্র। তবে বন্দরকর্মীরা অস্ত্রবোঝাইয়ের বিষয়টি জানতে পেরে জাহাজে অস্ত্র বোঝাই করতে অস্বীকৃতি জানান।
তাদের কঠোর অবস্থানের কারণ হলো, অস্ত্রগুলো ইতিমধ্যেই জাহাজে ছিল এবং এগুলো ইসরায়েল গামী। বন্দরকর্মীরা জাহাজে প্রবেশ করে অস্ত্র ও গোলাবারুদের উপস্থিতি নিশ্চিত করেন। ইতালির বন্দর কর্তৃপক্ষও বন্দরকর্মীদের এই পদক্ষেপকে সম্মান জানায় এবং অস্ত্র পাচারের বিষয়ে সচেতন থাকার প্রতিশ্রুতি দেয়।
ইতালির বন্দরকর্মীদের প্রতিবাদের পেছনের কারণ
ইতালির জেনোয়া বন্দরের বন্দরকর্মীদের সংগঠন ‘অটোনোমাস কালেক্টিভ অব পোর্ট ওয়ার্কার্স অ্যান্ড ইউনিয়ন’ ঘোষণা দিয়েছে, ‘আমরা যুদ্ধের জন্য কাজ করি না।’ এই প্রেক্ষাপটে তারা যুদ্ধব্যবসায় সরাসরি সহযোগিতা করতে চায় না এবং যেসব অস্ত্র ইসরায়েলের মতো সংবেদনশীল গন্তব্যে পাঠানো হয়, সেসব জাহাজে অস্ত্রবোঝাই বন্ধ করতে উদ্যোগ নিয়েছে।
২০১৯ সালে একই ধরনের প্রতিবাদের ফলে একটি অস্ত্রবোঝাই সৌদি জাহাজ আটকে দেয়া হয়েছিল। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের বন্দরকর্মীরা যৌথভাবে এমন পদক্ষেপ নিয়েছেন যাতে দখলদার ইসরায়েল গাজায় বর্বরতা চালাতে নতুন অস্ত্র না পায়।
সৌদি আরবের অবস্থান ও প্রতিক্রিয়া
সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় শিপিং কোম্পানি ‘বাহরি’ এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তারা তাদের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ‘এই অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন।’ তারা দাবি করেছে, তারা কখনোই ইসরায়েলে কোনও পণ্য বা অস্ত্র পরিবহন করেনি এবং এই ধরনের অভিযানে জড়িত ছিল না।
বাহরি কোম্পানি আরও বলেছে, তাদের সুনাম ক্ষুণ্ণ করার যে কোনও দাবির বিরুদ্ধে তারা আইনি ব্যবস্থা নিতে প্রস্তুত। তবে এই বিবৃতির পরেও যুক্তরাষ্ট্র থেকে অস্ত্রসহ জাহাজটি ইতালির জেনোয়া বন্দরে এসে পৌঁছানোর তথ্য এবং বন্দরকর্মীদের প্রতিবাদের ঘটনাটি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি করেছে।
অস্ত্র পাচার বিরোধী আন্দোলনের পটভূমি
ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরেই চলেছে। বিশ্বব্যাপী বেশ কিছু দেশের বন্দরকর্মী ও পরিবহনকারী সংস্থাগুলো অস্ত্র পাচারের বিরোধী আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। ইউরোপের বিভিন্ন বন্দরে এ ধরনের পদক্ষেপ নজরকাড়া।
২০১৯ সালের পর থেকে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য ও ফিলিস্তিনি সংকটের পটভূমিতে অস্ত্রবোঝাই জাহাজ আটকে দেওয়ার ঘটনাগুলো বেড়েছে। এর মাধ্যমে অস্ত্র পাচারের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিবাদ গড়ে উঠছে যা আন্তর্জাতিক মহলে প্রশংসিত হয়েছে।
আন্তর্জাতিক প্রভাব ও পরবর্তী সম্ভাবনা
এই ঘটনা আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। ইতালির জেনোয়া বন্দরের কর্তৃপক্ষ ঘোষণা দিয়েছে, আগামী সেপ্টেম্বর মাসে অস্ত্র পাচারের ওপর একটি স্থায়ী পর্যবেক্ষক দল গঠনের ব্যাপারে আলোচনা করা হবে। এর ফলে ভবিষ্যতে অস্ত্র পরিবহনের ক্ষেত্রে আরও কঠোর নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণের আশা দেখা যাচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরায়েল এবং সৌদি আরবের মধ্যে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকলেও, বাণিজ্যিক ও সামরিক সহযোগিতার কিছু গোপন দিক রয়েছে যা সম্প্রতি প্রকাশ্যে আসছে। এই পরিস্থিতি মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিক উত্তেজনা ও দ্বিধাবিভক্ততার দিকে ইঙ্গিত করছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও বিশ্লেষণ
বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার সংগঠনগুলো ইতালির বন্দরকর্মীদের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে। তারা মনে করছে, অস্ত্র পাচারের মতো সংবেদনশীল ও ঝুঁকিপূর্ণ কার্যক্রমের বিরুদ্ধে সজাগ থাকা উচিত। সামরিক সরঞ্জাম পরিবহন বন্ধ না করা হলে তা সংঘাত বৃদ্ধি ও নিরীহ মানুষের প্রাণহানির কারণ হতে পারে।
অপরদিকে, কিছু রাজনীতিবিদ ও বিশ্লেষক মনে করছেন, অস্ত্র পরিবহনের ওপর এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা ভবিষ্যতে সামরিক ও কূটনৈতিক সম্পর্কের জটিলতা বাড়াতে পারে। তবে তারা আশা প্রকাশ করেন, এই সমস্যাগুলো কূটনৈতিক সংলাপের মাধ্যমে সমাধান হবে।
সারসংক্ষেপ
ইতালির জেনোয়া বন্দরে সৌদি জাহাজে অস্ত্র বোঝাইয়ের ক্ষেত্রে বন্দরকর্মীদের প্রতিবাদ মধ্যপ্রাচ্য ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়। এটি যুদ্ধবিরোধী এবং মানবাধিকারের পক্ষে একটি শক্তিশালী বার্তা বহন করে। তবে বিষয়টি কতটা স্থায়ী হবে এবং ভবিষ্যতে অস্ত্র পাচার নিয়ন্ত্রণে এর প্রভাব কী হবে, তা সময়ের সাক্ষী থাকবে।
বিশ্লেষকদের মতে, এ ধরনের আন্তর্জাতিক উদ্যোগগুলো শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। তবে এই সংকট ও সংঘাত কীভাবে গড়াবে, তা নির্ভর করবে বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়ার ওপর।
এম আর এম – ০৮২৯, Signalbd.com



