হাত জোড় করে বাঁচার আকুতি, তবু শেষ রক্ষা হয়নি রূপলাল ও প্রদীপের

রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার সয়ার ইউনিয়নের বটতলা এলাকায় দুই ব্যক্তিকে সন্দেহজনকভাবে চোর সন্দেহে গণপিটুনির শিকার হতে হলো। ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে। হাত জোড় করে বাঁচার আকুতি করেও রূপলাল দাস ও প্রদীপ লাল নামের ওই দুই ব্যক্তির প্রাণ রক্ষা হয়নি।
ঘটনার বিবরণ
রূপলাল দাস (৪০) এবং প্রদীপ লাল (৩৫) রাতে বটতলা এলাকার একটি ভ্যানে করে যাচ্ছিলেন। স্থানীয় কয়েকজন তাদের আটক করে সন্দেহজনকভাবে তাদের ভ্যান থেকে একটি প্লাস্টিকের বস্তা বের করে দেখে। লোকজন তাদের নাম-পরিচয় জানতে চাইলে রূপলাল হাত জোড় করে অনুনয় করেন যে তিনি চোর বা ডাকাত নন, তিনি তারাগঞ্জ বাজারে জুতা সেলাই করেন।
ভিডিওতে দেখা যায়, যদিও তারা বারবার নিজেদের বেকসুর দাবি করেন, তবু স্থানীয়দের সন্দেহ কাটে না। রূপলাল প্রস্রাব করতে চাইলেও স্থানীয়রা তাকে পালানোর সন্দেহে যেতে দেয়নি। পরে দুজনকে মাটিতে লুটিয়ে পিটুনি দেওয়া হয় এবং বুড়িরহাট উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে নিয়ে গিয়ে সেখানে ফেলে দেওয়া হয়।
পরে আহত অবস্থায় তাদের উদ্ধার করে স্থানীয় হাসপাতাল নেওয়া হলে রূপলালকে মৃত ঘোষণা করা হয়। প্রদীপকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে ভোররাতে তারও মৃত্যু হয়।
এলাকার নিরাপত্তা ও উত্তেজনা
বুড়িরহাট ও আশপাশের এলাকায় গত কয়েক সপ্তাহ ধরে চুরি ও ডাকাতির ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছিল। বিশেষ করে ১০ থেকে ১২ দিন আগে শিশু ইরফান বাবুকে গলা কেটে হত্যা এবং ভ্যান ছিনতাইয়ের ঘটনা এলাকায় উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিল। ওই ঘটনার পর থেকে স্থানীয় মানুষজন অনেক বেশি সতর্ক এবং চোর সন্দেহে দ্রুত কঠোর ব্যবস্থা নিতে শুরু করে।
রূপলাল ও প্রদীপের ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে কয়েকশ মানুষ দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে এসে গণপিটুনিতে অংশ নেন। স্থানীয়রা জানান, সন্দেহজনক অবস্থায় ভ্যানে থাকা ব্যক্তিদের আটক করার সময় রূপলাল ও প্রদীপ হাত জোড় করে বাঁচার অনুনয় করলেও কেউ শুনেনি।
স্থানীয়দের প্রতিক্রিয়া ও বিক্ষোভ
ঘটনার পর থেকে এলাকাটি এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতায় পড়েছে। বুড়িরহাট ও আশপাশের গ্রামগুলোতে পুরুষশূন্য অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। রূপলালের বাড়ি এলাকায় কান্নার শব্দ শোনা যায়, স্বজনরা ভিড় করছে এবং বিক্ষোভ চলছে।
স্থানীয়রা বলেন, “আমরা কখনোই চুরি-ডাকাতির বিরুদ্ধে কোন সহিংসতা চাই না, কিন্তু অনেকবার পুলিশি ব্যবস্থা না নেওয়ায় আমরা আমাদের নিরাপত্তা নিজেরাই নিতে বাধ্য হচ্ছি।”
পুলিশের পদক্ষেপ ও তদন্তের অগ্রগতি
তারাগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এম এ ফারুক জানান, ভিডিও বিশ্লেষণ ও স্থানীয় সূত্রের তথ্যের ভিত্তিতে চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে রয়েছে সয়ার ইউনিয়নের বালাপুর গ্রামের এবাদত হোসেন, বুড়িরহাট এলাকার আক্তারুল ইসলাম, রফিকুল ইসলাম এবং রহিমাপুর এলাকার মিজানুর রহমান।
ওসি আরও বলেন, “গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। যারা অন্যরা জড়িত, তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। কেউই অপরাধের বাইরে থাকবেন না।”
রূপলালের স্ত্রী ভারতী রানী নিহতদের নামে ৭০০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে হত্যা মামলা করেছেন।
গণপিটুনির ভয়াবহতা ও মানবাধিকার দৃষ্টিকোণ
বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে চোর সন্দেহে গণপিটুনি বা ঝগড়াঝাঁটি একটি দীর্ঘদিনের সমস্যা। তবে বিচারবিহীন এই ধরনের নিপীড়ন মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং আইনের শাসনকে চ্যালেঞ্জ করে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “গণপিটুনি কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। সন্দেহ থাকলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর মাধ্যমে তদন্ত ও বিচার হওয়া উচিত। এটি না হলে সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পাবে এবং সঠিক বিচার নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হবে না।”
সামাজিক প্রতিক্রিয়া ও আলোচনার প্রসার
ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হবার পর ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। অনেকেই পিটুনিতে জড়িতদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। এ ঘটনার মাধ্যমে স্থানীয় প্রশাসন এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার উপর আস্থা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
অনেকে সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তাও জোর দিয়েছেন।
ভবিষ্যৎ করণীয় ও আশঙ্কা
এই ধরনের ঘটনা থেকে শেখার প্রয়োজন রয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে যাতে সাধারণ মানুষ আইনকে নিজের হাতে না তুলে নেয়। একই সাথে সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে হবে যাতে ঝগড়াঝাঁটির মাধ্যমে দ্রুত বিচার চেয়ে অন্যায় বিচার না হয়।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, গ্রামীণ এলাকাগুলোতে আইনের শাসন নিশ্চিত করা না হলে এমন ঘটনা পুনরায় ঘটতে পারে, যা সমাজে বিশৃঙ্খলা ও অস্থিরতা ডেকে আনবে।
এম আর এম – ০৮০৬, Signalbd.com