যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কের টানাপোড়েন, আঞ্চলিক ভূরাজনীতি ও কূটনৈতিক উত্তেজনার মধ্যেই চীন সফরে যাচ্ছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা (এসসিও)-এর আঞ্চলিক সম্মেলনে অংশ নিতে তিনি এই সফরে যাচ্ছেন। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বর্তমান ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মোদির এই সফর কেবল আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং কৌশলগত ভারসাম্য রক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
তিয়ানজিনে অনুষ্ঠিত হবে এসসিও সম্মেলন
এসসিও-এর ২০২৫ সালের আঞ্চলিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে চীনের তিয়ানজিন শহরে, ৩১ আগস্ট থেকে ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। এই সম্মেলনে অংশ নেবেন সদস্য দেশগুলোর রাষ্ট্রপ্রধানরা, যার মধ্যে থাকবেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং।
ভারত সরকার সূত্রে জানা গেছে, এসসিও সম্মেলনের ফাঁকে মোদির সঙ্গে পুতিন ও শি জিনপিংয়ের দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও এখনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসেনি, তবে একাধিক কূটনৈতিক সূত্র বিষয়টি ইঙ্গিত করেছে।
যুক্তরাষ্ট্র-ভারত বাণিজ্যিক টানাপোড়েনের প্রেক্ষাপট
সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে শুল্ক ও বাণিজ্যিক সিদ্ধান্ত নিয়ে বেশ কয়েক দফা উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। মার্কিন প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভারতীয় পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করায় নয়াদিল্লিতে অস্বস্তি তৈরি হয়েছে।
বিশেষ করে প্রযুক্তি ও ওষুধ খাতে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এবং ভারতের পাল্টা প্রতিক্রিয়া দুই দেশের সম্পর্কে জটিলতা বাড়িয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে চীন সফর করে মোদি কার্যত বিকল্প জোট ও সম্পর্ক গঠনের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন বলেই মনে করছেন কূটনীতিকরা।
চীন-ভারত সম্পর্ক: অতীত সংঘর্ষ ও ভবিষ্যতের বার্তা
২০২০ সালে লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় চীন ও ভারতের সেনাবাহিনীর মধ্যে প্রাণঘাতী সংঘর্ষের পর দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক ব্যাপকভাবে অবনতি ঘটে। সীমান্তে টানা উত্তেজনা, সামরিক প্রস্তুতি এবং রাজনৈতিক বাকযুদ্ধের মধ্যেই গত কয়েক বছরে দুই পক্ষ একাধিকবার বৈঠক করলেও উত্তেজনা পুরোপুরি প্রশমিত হয়নি।
মোদি সর্বশেষ ২০১৯ সালে চীন সফর করেছিলেন। সেদিক থেকে এটি হবে প্রায় সাত বছর পর তার প্রথম চীন সফর। এই সফরকে তাই দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার আরেকটি প্রচেষ্টা হিসেবেও দেখা হচ্ছে।
এসসিও ফোরামে ভারতের ভূমিকাই বা কী?
সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা মূলত একটি আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা ভিত্তিক জোট, যেখানে চীন, রাশিয়া, ভারত, পাকিস্তান, ইরানসহ মোট আটটি দেশ সদস্য হিসেবে রয়েছে। বিগত কয়েক বছর ধরে ভারত এই ফোরামে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছে।
ভারতকে ঘিরে পশ্চিমা বিশ্বের যেমন কৌশলগত আগ্রহ রয়েছে, তেমনি রাশিয়া ও চীনও চাইছে ভারত যেন এসসিও ও ব্রিকসের মতো জোটে তাদের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারত্ব বজায় রাখে। এই জোটের ভবিষ্যৎ নীতি ও প্রকল্পে ভারতের অংশগ্রহণ তাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
মোদির সফরে কী থাকবে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে?
বিশ্লেষকদের মতে, মোদির এই সফরে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনার কেন্দ্রে থাকবে—
- সীমান্ত নিরাপত্তা ও সামরিক উত্তেজনা প্রশমনের কৌশল
- এসসিও সদস্য দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য সহযোগিতা
- চীন-ভারত দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ ও প্রকল্প
- দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা পরিস্থিতি ও সন্ত্রাস দমন
- মার্কিন প্রভাবের বিপরীতে একটি কৌশলগত ভারসাম্য রক্ষার নীতি
বিশ্লেষক অজয় শঙ্কর বলেন, “এই সফর শুধু এসসিও-এর আনুষ্ঠানিকতা নয়, এটি ভারতীয় কূটনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত।”
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে?
মোদি যখন চীন সফরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তখন ওয়াশিংটনের প্রতিক্রিয়া বেশ সতর্ক। একদিকে, যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক আরও জোরদার করতে চায়, অন্যদিকে মোদির চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তাদের দৃষ্টিতে কিছুটা উদ্বেগের বিষয়।
বিশেষ করে, ভারত যদি চীনের নেতৃত্বাধীন বৃহৎ অর্থনৈতিক প্রকল্পগুলোতে অংশগ্রহণ বাড়ায়, তাহলে সেটি যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইন্দো-প্যাসিফিক’ কৌশলের জন্য চাপের কারণ হয়ে উঠতে পারে।
চীন সফরের পর মোদির পরবর্তী কূটনৈতিক তৎপরতা
চীন সফরের পর মোদি অংশ নেবেন জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে। সেখানে তিনি বিশ্বনেতাদের সামনে দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি ও সহযোগিতার বার্তা তুলে ধরবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এছাড়া ২০২৫ সালের শেষ দিকে ভারতের মাটিতে অনুষ্ঠিতব্য জি-২০ বৈঠকের প্রস্তুতিও এই সফরের আলোচনায় প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে পারে।
সারসংক্ষেপ
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্ক, চীন-ভারত সীমান্ত ইস্যু, এবং বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক টানাপোড়েন—সব মিলিয়ে মোদির এই চীন সফরকে একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত পদক্ষেপ হিসেবে দেখা যাচ্ছে। এটি শুধু দ্বিপক্ষীয় নয়, বরং আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলবে বলেই মনে করা হচ্ছে।
তবে বিশ্লেষকদের মতে, সফরের প্রকৃত সফলতা নির্ভর করবে চীন ও ভারতের মধ্যে বিশ্বাস পুনর্গঠনের বাস্তব অগ্রগতির ওপর।
এম আর এম – ০৭২৮, Signalbd.com



