বাংলাদেশ

জুলাই আন্দোলনে নিহত অজ্ঞাতনামা ১১৪ জনের লাশ উত্তোলনের নির্দেশ

 ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন এলাকায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহত ১১৪ জন অজ্ঞাতনামা শহীদের মরদেহ শনাক্তে কবর থেকে উত্তোলনের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। পোস্টমর্টেম ও ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে পরিচয় নিশ্চিত করে পরিবারের কাছে হস্তান্তরের উদ্যোগ নেওয়া হবে।

আদালতের নির্দেশনায় রায়েরবাজার কবরস্থানে বড় পদক্ষেপ

ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান সোমবার (৪ আগস্ট) এক গুরুত্বপূর্ণ আদেশ দিয়েছেন। তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় নিহত ১১৪ জন অজ্ঞাতনামা শহীদের মরদেহ রায়েরবাজার কবরস্থান থেকে উত্তোলনের নির্দেশ দিয়েছেন। পুলিশ পক্ষ থেকে দেওয়া আবেদনের ভিত্তিতে এই নির্দেশ আসে।

মোহাম্মদপুর থানার উপপরিদর্শক মো. মাহিদুল ইসলাম আদালতে লাশ উত্তোলনের আবেদন করেন। আবেদনে বলা হয়, আন্দোলনের সময় নিহত ব্যক্তিদের সঠিক পরিচয় শনাক্তের জন্য মরদেহ উত্তোলন করে ডিএনএ সংগ্রহ ও পোস্টমর্টেম করানো জরুরি।

আন্দোলনের পটভূমি ও শহীদের দাফনের প্রেক্ষাপট

জুলাই মাসজুড়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে সহিংসতার মধ্যে বহু মানুষ নিহত হন। এদের মধ্যে অনেকের পরিচয় এখনো অজানা। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে উদ্ধার করা অজ্ঞাতনামা মরদেহগুলো মোহাম্মদপুর থানাধীন রায়েরবাজার কবরস্থানে দাফন করা হয়।

আন্দোলনকারীদের মধ্যে নারী, পুরুষ, কিশোর-কিশোরী – বিভিন্ন বয়স ও পেশার মানুষ ছিলেন, যারা জীবন দিয়েও সমান অধিকারের দাবিতে লড়াই চালিয়ে গেছেন।

মরদেহ উত্তোলনের আইনগত ভিত্তি

আদালতের আদেশে বলা হয়েছে, ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির ১৭৬(২) ধারার বিধান অনুসারে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে নিয়োগ দিয়ে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশও দেওয়া হয়েছে।

লাশ উত্তোলন, ডিএনএ প্রোফাইলিং এবং পরিচয় নিশ্চিত করে প্রয়োজনে পরিবারের কাছে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া পুরোপুরি আইনি কাঠামোর মধ্যেই সম্পন্ন হবে।

ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে পরিচয় শনাক্তের পরিকল্পনা

আবেদনে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, প্রতিটি মরদেহের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে তা সংরক্ষণ করা হবে। পরবর্তীতে নিহতদের স্বজনদের ডিএনএ নমুনার সঙ্গে মিলিয়ে পরিচয় নির্ধারণের কাজ করা হবে।

এই উদ্যোগে শহীদদের পরিচয় নিশ্চিত করে পরিবারকে জানানো, মরদেহ হস্তান্তর এবং প্রয়োজনে আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফনের ব্যবস্থা করা হতে পারে।

পরিবারের স্বজনদের জন্য মানবিক দৃষ্টিকোণ

শহীদদের পরিবারের জন্য এই সিদ্ধান্ত অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে নিহতদের খোঁজে বহু পরিবার হাসপাতাল, মর্গ ও পুলিশ স্টেশনে ঘুরেও সঠিক তথ্য পাননি। আদালতের এই নির্দেশে নতুন আশার আলো দেখছেন অনেকেই।

একজন শহীদের বড় ভাই নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,
“আমার ভাই ২৬ জুলাইয়ের ঘটনার পর থেকে নিখোঁজ। এখন যদি ডিএনএর মাধ্যমে তার মরদেহ শনাক্ত হয়, অন্তত জানবো কোথায় শেষ হয়েছে তার জীবন।”

রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া

এই আদেশকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন আলোচনার জন্ম হয়েছে। অনেকে বলছেন, সরকার এই পদক্ষেপের মাধ্যমে আন্দোলনে নিহতদের মর্যাদা দিতে চাচ্ছে। আবার কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন, কেন এতদিন পর এই সিদ্ধান্ত এলো।

মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে দাবি উঠেছে, নিহতদের দ্রুত পরিচয় নিশ্চিত করে তাদের পরিবারকে সহযোগিতা করতে হবে এবং যদি কেউ বিচার বহির্ভূত হত্যার শিকার হয়ে থাকেন, তা তদন্ত করে দোষীদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে।

বিশ্লেষকদের দৃষ্টিভঙ্গি

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. শাকিল আহমেদ বলেন,
“১১৪ জন অজ্ঞাতনামা লাশের ডিএনএ শনাক্তের উদ্যোগ নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। তবে এটা একইসঙ্গে রাষ্ট্রের দায় ও সংকটের প্রতিচ্ছবিও।”

তিনি আরও বলেন, রাষ্ট্র যদি সময়মতো তথ্য সংগ্রহ, মৃতদেহ শনাক্ত ও জনসাধারণকে জানাতে পারত, তাহলে এতজন মানুষ অজ্ঞাত থেকে যেত না।

ভবিষ্যতের করণীয় ও জনআশা

আদালতের আদেশ বাস্তবায়নে যেসব সংস্থা ও কর্মকর্তা দায়িত্ব পাবেন, তাদের প্রতি সর্বোচ্চ পেশাদারিত্ব ও মানবিকতা প্রদর্শনের আহ্বান জানানো হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট পরিবারের জন্য মনো-সামাজিক সহায়তার ব্যবস্থাও জরুরি।

এই পদক্ষেপ ভবিষ্যতের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে কিনা, তা নির্ভর করবে কর্তৃপক্ষের কার্যকর বাস্তবায়ন ও স্বচ্ছতার ওপর।

সারসংক্ষেপ  

নিহত ১১৪ জন শহীদের মরদেহ শনাক্তে কবর থেকে উত্তোলনের এই আদেশ শুধু একটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়, এটি একটি মানবিক দায়িত্ব। হাজারো স্বজনের বুকে জমে থাকা দীর্ঘ অপেক্ষা, যন্ত্রণা ও প্রশ্নের জবাব মিলতে পারে এই উদ্যোগের মাধ্যমে। তবে এই প্রক্রিয়া যেন দায়িত্বহীনতার শিকার না হয়, সে দিকে কড়া নজর রাখা জরুরি।

এম আর এম – ০৬৯৪, Signalbd.com

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button