বর্তমানে বিশ্বব্যাপী হালাল অর্থনীতি একটি বিশাল ও দ্রুত বর্ধনশীল খাত হিসেবে দাড়িয়েছে। ৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের এই বিশাল বাজারে বাংলাদেশ তার অবস্থান শক্ত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) এবং বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন সম্প্রতি এক সেমিনারে এই প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।
ঢাকার একটি আন্তর্জাতিক হোটেলে ‘হালাল ইকোনমি ৩৬০ : ড্রাইভিং গ্লোবাল গ্রোথ’ শীর্ষক সেমিনারে বাংলাদেশের হালাল অর্থনীতির অবস্থা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা হয়। বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (বিএমসিসিআই) এই সেমিনারের আয়োজন করে।
হালাল অর্থনীতি: বাংলাদেশের জন্য এক বিশাল সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ
বিডা’র নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বলেন, বিশ্বে অধিকাংশ হালাল পণ্য অমুসলিম দেশগুলো উৎপাদন করছে, যা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশের জন্য দুঃখজনক একটি বিষয়। কিন্তু তিনি বলেন, এই পরিস্থিতি আমাদের জন্য বিরাট সুযোগও বটে। সঠিক নীতি প্রণয়ন ও কার্যকর উদ্যোগের মাধ্যমে বাংলাদেশ হালাল অর্থনীতির এই বিশাল বাজারে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান গড়ে তুলতে পারে।
তিনি আরো জানান, সরকার ইতোমধ্যে বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং হালাল উৎপাদনের জন্য অবকাঠামো উন্নয়নে নানা ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তবে সরকারি-বেসরকারি খাতের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা না হলে হালাল অর্থনীতির পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগানো সম্ভব নয়।
বৈশ্বিক হালাল অর্থনীতি: প্রবৃদ্ধির বিশাল সম্ভাবনা
বিশ্বব্যাপী হালাল খাদ্য, পণ্য ও সেবার বাজারের পরিসর দিন দিন বাড়ছে। বিএমসিসিআই’র সভাপতি সাব্বির এ খান বলেন, ২০২৫ সালে বৈশ্বিক হালাল খাদ্যবাজারের আকার হবে প্রায় ৩.৩০ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ২০৩৪ সালের মধ্যে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়াবে ৯.৪৫ ট্রিলিয়ন ডলারে। এ সময়ে বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধির হার হবে ১২.৪২ শতাংশ, যা একটি অত্যন্ত দ্রুতগতির বৃদ্ধি সূচক।
তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির পাশাপাশি হালাল পণ্যের রপ্তানিতে বিশেষ মনোযোগ দিলে দেশটি এই লাভজনক বাজারে বিশাল অংশীদার হতে পারবে। সুনির্দিষ্ট নীতি, সহজ সনদ প্রক্রিয়া এবং বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ থাকলে, মাত্র ১০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ শুধু মালয়েশিয়ায় ৭-৮ বিলিয়ন ডলারের হালাল পণ্য রপ্তানি করতে সক্ষম হবে।
বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া সহযোগিতা: হালাল অর্থনীতির শক্তি বৃদ্ধি
সেমিনারে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত মালয়েশিয়ার হাইকমিশনার মোহাম্মদ শুহাদা ওসমান। তিনি বাংলাদেশ-মালয়েশিয়ার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের শক্তি এবং হালাল অর্থনীতি গঠনে মালয়েশিয়ার অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, “এই সহযোগিতা উভয় দেশের জন্য উল্লেখযোগ্য সুফল বয়ে আনবে এবং হালাল অর্থনীতি আরও সুদৃঢ় হবে।”
তবে বর্তমান বাংলাদেশ-মালয়েশিয়ার বাণিজ্যে ভারসাম্যহীনতা একটি বড় প্রতিবন্ধকতা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ মালয়েশিয়া থেকে ২.৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করলেও, একই সময়ে রপ্তানি ছিল মাত্র ২৯৩.৫১ মিলিয়ন ডলার। এই ব্যবধান কমানোর জন্য হালাল পণ্যের বাজার বিস্তারে দুই দেশের মধ্যে কার্যকর সহযোগিতা জরুরি।
হালাল অর্থনীতির সেক্টরগুলো এবং বাংলাদেশের অবদান
হালাল অর্থনীতি শুধু খাদ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি অন্তর্ভুক্ত করে ফ্যাশন, কসমেটিকস, ঔষধ, পর্যটন, ফাইন্যান্স, এবং আরও নানা সেক্টর। বিশেষ করে হালাল ফিনান্স সেক্টর দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে। ইসলামী ব্যাংকিং ও টাকাফুল সেবা বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।
বাংলাদেশে বর্তমানে ইসলামী ব্যাংকিং খাত ত্বরান্বিত হচ্ছে এবং অনেক কোম্পানি হালাল ফ্যাশন ও কসমেটিকস পণ্যের বাজারে প্রতিযোগিতা করছে। সঠিক নীতিমালা ও আন্তর্জাতিক মানের সাথে খাপ খাইয়ে এগিয়ে গেলে বাংলাদেশ হালাল অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হয়ে উঠতে পারে।
সরকারের উদ্যোগ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
বাংলাদেশ সরকার হালাল অর্থনীতি শক্তিশালী করতে বেশ কিছু নীতি গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) ও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে কাজ করছে। হালাল উৎপাদনের জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হচ্ছে এবং বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য বিভিন্ন প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে।
সরকারের লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে হালাল পণ্যের আঞ্চলিক হাব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। এ জন্য স্থানীয় উৎপাদন বাড়ানো, আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করা এবং সনদ প্রক্রিয়া সহজতর করা হচ্ছে। পাশাপাশি, সরকার মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও অন্যান্য মুসলিম প্রধান দেশের সঙ্গে সহযোগিতা বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে।
সামগ্রিক প্রতিক্রিয়া ও সমালোচনা
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশ যদি সঠিক দিকনির্দেশনা ও কার্যকর বাস্তবায়ন করতে পারে, তাহলে ৭ ট্রিলিয়ন ডলারের বিশ্ববাজার থেকে লাভবান হওয়া কঠিন হবে না। তবে সুশাসন, প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করাটাই মূল চাবিকাঠি।
অনেকেই মনে করেন, আমাদের বর্তমান অবকাঠামো এবং নীতি প্রণয়নে কিছু দুর্বলতা আছে যা দ্রুত দূর করতে হবে। বিশেষ করে সনদপত্র প্রদান ও বাজারজাতকরণ ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও সহজলভ্যতা বাড়ানো জরুরি। এছাড়া সরকারি-বেসরকারি খাতের মধ্যে সমন্বয় আরো গভীর করতে হবে।
সংক্ষেপে:
- ৭ ট্রিলিয়ন ডলারের হালাল অর্থনীতিতে বাংলাদেশ চাইছে শক্ত অবস্থান।
- সরকার এবং বেসরকারি খাত একসাথে কাজ করে হালাল পণ্যের আঞ্চলিক হাব গড়ার পরিকল্পনা করছে।
- বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া সহযোগিতায় ব্যবসা ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে।
- ২০৩৪ সালের মধ্যে বৈশ্বিক হালাল খাদ্যবাজারের আকার ৯.৪৫ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছানোর প্রত্যাশা।
- সরকারের নানা উদ্যোগের মাধ্যমে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি হচ্ছে।
- হালাল ফ্যাশন, কসমেটিকস, ফিনান্স, পর্যটনসহ অন্যান্য সেক্টরেও বাংলাদেশের সম্ভাবনা রয়েছে।
MAH – 12119 , Signalbd.com



