শিক্ষা

নির্মাণ না হয়ে অর্ধমরমি প্রকল্পে ২৮ কোটি টাকা ফুরিয়ে যাবে!

Advertisement

২৮ কোটি টাকার শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও অসমাপ্ত অটিজম একাডেমি: এক ট্র্যাজিক গল্প

দেশের অটিজম ও স্নায়ুবিকাশজনিত প্রতিবন্ধী শিশুদের উন্নয়নে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ন্যাশনাল একাডেমি ফর অটিজম অ্যান্ড নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅ্যাবিলিটি প্রকল্পে যতটা আশা ছিল, তার তুলনায় এখন যেন পুরো প্রকল্পেই অন্ধকার দেখা যাচ্ছে।

প্রায় ১১ বছর ধরে চলছে এই প্রকল্প, যেখানে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে ইতিমধ্যেই খরচ হয়েছে ২৮ কোটি টাকার বেশি। অথচ, প্রকল্পটি অসমাপ্ত রেখেই শিক্ষা মন্ত্রণালয় এই প্রকল্প বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অর্থাৎ পূর্ণাঙ্গ অটিজম একাডেমি নির্মাণের স্বপ্ন ভেস্তে যাচ্ছে, আর এ পর্যন্ত বিনিয়োগ করা কোটি কোটি টাকা গচ্ছা হয়ে যেতে পারে।

প্রকল্পের অগ্রগতি ও ব্যয়: ৭৩০ কোটি টাকার প্রকল্পে মাত্র ৯৫ কোটি টাকা খরচ

২০১৪ সালে শুরু হওয়া এই প্রকল্পের প্রথম টেকসই বাজেট ছিল ৭৪ কোটি ১০ লাখ টাকা। কিন্তু বিভিন্ন পরিবর্তন ও প্রকল্প সম্প্রসারণের কারণে বর্তমানে এর বাজেট দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭৩০ কোটি ৬০ লাখ টাকা

তবে ১১ বছরে প্রকল্পে মাত্র ৯৪ কোটি ৯৮ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। যার মধ্যে:

  • শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে খরচ: ২৮ কোটি টাকার বেশি
  • জমি ক্রয়ে ব্যয়: ৩৫ কোটি টাকা
  • বাকিটা খরচ হয়েছে সভা-সেমিনার, ক্যাম্পাস পরিচালনা, ভর্তি প্রক্রিয়া ও অন্যান্য প্রশাসনিক কাজে।

অর্থনৈতিক অগ্রগতি মাত্র ১২.৯২% এবং বাস্তব অগ্রগতি মাত্র ২০%

জমি অধিগ্রহণ ও প্রশাসনিক জটিলতা: প্রকল্পের অন্যতম বাধা

প্রকল্পের শুরুতেই মহাখালীতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দকৃত দুই একর জমি মামলা-বিবাদে জটিল হওয়ায় অধিগ্রহণ সম্ভব হয়নি। পরে পূর্বাচলে ৩.৩৩ একর জমি বরাদ্দ দেওয়া হলেও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ, দরপত্র ও অন্যান্য আইনি জটিলতার কারণে প্রকল্পের কাজ স্থবির হয়ে পড়ে।

গত বছর ২৯ সেপ্টেম্বর পরিকল্পনা কমিটির সভায় এই প্রকল্প অসমাপ্ত রেখেই বন্ধ করার প্রস্তাব আসে। মন্ত্রণালয়ও সেই পথে হাঁটার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আগামী ৪ আগস্ট পরিকল্পনা কমিশনের সভায় এ নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ: ব্যয় বড়, কাজে ছোট?

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এ সিদ্ধান্ত শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে খরচ হওয়া অর্থকে অর্থহীন করে দেবে। কারণ এই প্রশিক্ষণ থেকে শিক্ষকদের দক্ষতা বাড়লেও, একটি পূর্ণাঙ্গ একাডেমি না থাকায় তারা প্রয়োজনে সঠিকভাবে কাজ করতে পারবে না।

অস্থায়ী ক্যাম্পাসে যারা অটিজম ও স্নায়ুবিক বিকাশজনিত সমস্যাগ্রস্ত শিশুদের শিক্ষাদান করছে, তাদের ভবিষ্যত অনিশ্চিত। ফলে এই শিশুদের মূলধারায় ফিরিয়ে আনার উদ্যোগও বাধাগ্রস্ত হবে।

প্রকল্প পরিচালকের বক্তব্য

প্রকল্প পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) ড. মো. নুরুল আলম “এই প্রকল্প বন্ধ করার সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছে, তাই আমার কোনো মন্তব্য নেই”– এমনটি জানিয়েছেন।

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষার দপ্তরের ভূমিকা

এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। মাউশির একাধিকবার এ প্রকল্পের গতি বাড়ানোর জন্য কাজ করার চেষ্টা করা হলেও জমি-দরপত্রের জটিলতা প্রকল্পের ধীরগতির প্রধান কারণ বলে জানানো হয়।

২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে মাউশির মহাপরিচালক অধ্যাপক এ বি এম রেজাউল করিম সরকারের কাছে লিখিত আবেদন করেন সীমিত আকারে হলেও পূর্বাচলে স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণের অনুমতি দেওয়ার জন্য। এই ক্যাম্পাসে ভর্তি অটিজম ও স্নায়ুবিক বিকাশজনিত সমস্যাগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের জন্য কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়।

তবে এখন পর্যন্ত এই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হয়নি।

ভবিষ্যৎ ও সম্ভাবনা

প্রকল্পটির ভবিষ্যৎ নিয়ে সারা দেশে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। একদিকে যেখানে অটিজম আক্রান্ত শিশুরা বিশেষ শিক্ষার অধিকার পেতে অপেক্ষা করছে, সেখানে এই প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেলে তাদের শিক্ষাজীবন বিপন্ন হবে।

পরিকল্পনা কমিশনের আগামী সভায় যদি প্রকল্প বন্ধের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়, তবে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করা কোটি কোটি টাকার বিনিয়োগই বৃথা হবে। আর এ অবস্থায় নতুন উদ্যোগের অভাব অটিজম শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উন্নয়নকে ব্যাহত করবে।

সার্বিক বিশ্লেষণ ও সুপারিশ

১. জমি অধিগ্রহণের আইনি সমস্যা সমাধান: সরকারকে দ্রুত জমি সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি করে প্রকল্পের স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণ নিশ্চিত করতে হবে।

২. প্রকল্পের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন: অসমাপ্ত প্রকল্প সম্পন্ন করে শতভাগ কার্যকরী অটিজম একাডেমি প্রতিষ্ঠার জন্য অর্থ ও সময় বরাদ্দ করতে হবে।

৩. শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ফলপ্রসূ ব্যবহার: প্রশিক্ষণ সম্পন্ন শিক্ষকদের দক্ষতা কাজে লাগাতে অস্থায়ী ক্যাম্পাসের পরিবর্তে স্থায়ী একাডেমি স্থাপন জরুরি।

৪. অটিজম শিশুদের জন্য বিশেষ শিক্ষা: মূলধারায় ফেরানোর লক্ষ্যে সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ সহায়তা ও মনিটরিং ব্যবস্থা চালু করা উচিত।

দেশের অটিজম ও স্নায়ুবিক বিকাশজনিত প্রতিবন্ধীদের জন্য দীর্ঘ দিনের প্রতীক্ষিত প্রকল্প অসমাপ্ত রেখে শিক্ষা মন্ত্রণালয় যে সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে, তা একটি চিন্তার বিষয়। ১১ বছরের কাজের ফলাফল যেন বৃথা না যায়, সেই দায়িত্ব এখন সরকারের হাতে।

প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে আগামী ৪ আগস্টের পরিকল্পনা কমিশনের সভায় সবার আশা, যেন দেশ ও সমাজের পক্ষ থেকে একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

 MAH – 12096 ,  Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button