বিশ্ব

ইসরায়েলের গোয়েন্দাদের জন্য আরবি ভাষা ও ইসলামি জ্ঞান বাধ্যতামূলক

Advertisement

ইসরায়েলি সামরিক গোয়েন্দাদের জন্য আরবি ভাষা ও ইসলামি ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান অর্জন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ২০২৩ সালের গোয়েন্দা ব্যর্থতার পরিপ্রেক্ষিতে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) গোয়েন্দা শাখার জন্য এই নতুন প্রশিক্ষণ চালু করেছে। আগামী বছরের মধ্যে গোয়েন্দাদের শতভাগকে ইসলামি স্টাডিজে এবং অর্ধেককে আরবি ভাষায় দক্ষ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

গোয়েন্দা ব্যর্থতার প্রেক্ষাপট ও পরিবর্তনের কারণ

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার একটি বড় ব্যর্থতা প্রকাশ পেয়েছিল। এই ঘটনার পর থেকে গোয়েন্দা কার্যক্রমে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও উন্নত প্রযুক্তি প্রয়োগের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত দক্ষতাও গুরুত্ব পেতে শুরু করে।

ইসরায়েলি সামরিক গোয়েন্দাদের মধ্যে আরবি ভাষা ও ইসলামি ধর্মের জ্ঞানের অভাব দীর্ঘদিনের একটি বড় সমস্যা ছিল। মধ্যপ্রাচ্যের এই অঞ্চলে আরবি ভাষা ও ইসলামের গভীরতা না বোঝার কারণে গোয়েন্দারা প্রয়োজনীয় তথ্য সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করতে পারছিলেন না। বিশেষত, ইয়েমেন, সৌদি আরব ও অন্যান্য আরব দেশগুলোতে ব্যবহার হয় এমন স্থানীয় উপভাষা ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য বুঝতে তাদের অসুবিধা হচ্ছিল।

নতুন প্রশিক্ষণ নীতিমালা: কী পরিবর্তন আসছে?

১. আরবি ভাষায় দক্ষতা অর্জন
ইসরায়েলি সামরিক গোয়েন্দাদের জন্য আরবি ভাষা শেখা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সামরিক গোয়েন্দা পরিদপ্তর ‘আমান’-এর কর্মীদের অর্ধেককে আরবি ভাষায় পারদর্শী করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে তারা আরব অঞ্চলের যোগাযোগ, সংবাদ সংগ্রহ ও সাংকেতিক বার্তা বিশ্লেষণে আরও কার্যকর হবেন।

২. ইসলামিক স্টাডিজে প্রশিক্ষণ
ইসলামের মৌলিক জ্ঞান ও সংস্কৃতি সম্পর্কে গোয়েন্দাদের গভীর ধারণা থাকা জরুরি। এই কারণে ইসলামিক স্টাডিজকে গোয়েন্দা প্রশিক্ষণের একটি মূল অংশ হিসেবে নেওয়া হচ্ছে। ইসলামি ধর্মীয় রীতি-নীতি, সমাজব্যবস্থা ও ইতিহাস বোঝার মাধ্যমে গোয়েন্দারা আরব অঞ্চলের মানুষের মনোভাব ও নীতি বুঝতে পারবেন।

৩. স্থানীয় উপভাষা ও সাংস্কৃতিক পার্থক্যের গুরুত্ব
হুতি বিদ্রোহী এবং ইরাকি উপভাষায় বিশেষ প্রশিক্ষণের ওপরও গুরুত্ব দেওয়া হবে। ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের সংকেত ভাষা (ডিকোডিং) বুঝতে গোয়েন্দারা এখনও সমস্যায় পড়েন।

৪. মাদকদ্রব্য কাত ও কথার অস্পষ্টতা
ইয়েমেনের কিছু অঞ্চলে প্রচলিত ‘কাত’ নামক মাদকদ্রব্য ব্যবহারের ফলে কথাবার্তা অস্পষ্ট ও বিভ্রান্তিকর হয়। এই সংস্কৃতি বোঝার মাধ্যমে গোয়েন্দারা কথোপকথনের প্রকৃত অর্থ ধরতে পারবেন।

আমানের প্রধানের বক্তব্য

মেজর জেনারেল শ্লোমি বিন্ডার, যিনি সামরিক গোয়েন্দা ‘আমান’-এর প্রধান, এই পরিবর্তনের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “আমরা সংস্কৃতি, ভাষা এবং ধর্মীয় বিষয়ে আগে যথেষ্ট ভালো ছিলাম না। এই তিন ক্ষেত্রেই আমাদের উন্নতি করতে হবে। আমরা চাই না গোয়েন্দারা আরব গ্রামে বড় হওয়া বাচ্চাদের মতো হোক, তবে ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে তাদের মধ্যে সন্দেহ এবং গভীর পর্যবেক্ষণ তৈরির দক্ষতা বাড়ানো প্রয়োজন।”

এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, “আমাদের গোয়েন্দারা এখন থেকে শুধু তথ্য সংগ্রহ করবে না, সেই তথ্যের অর্থ বিশ্লেষণ ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট বুঝতেও পারদর্শী হবে।”

নতুন প্রশিক্ষণ বিভাগ ও শিক্ষাব্যবস্থা

আইডিএফ নতুনভাবে একটি আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের পরিকল্পনা করছে। এই বিভাগ গোয়েন্দাদের ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক দক্ষতা বৃদ্ধি করবে।

তাছাড়া, ইসরায়েলের মাধ্যমিক ও উচ্চ বিদ্যালয়গুলিতে ‘তেলেম’ নামে একটি বিভাগ পুনরায় চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে। এটি আরবি ও মধ্যপ্রাচ্য অধ্যয়নের জন্য নিবেদিত ছিল। আগে বাজেট সংকটের কারণে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, যার ফলে আরবি ভাষায় দক্ষ কর্মীর সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমে গিয়েছিল। এই বিভাগ চালু হলে ভবিষ্যতের গোয়েন্দাদের মধ্যে ভাষাগত দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে।

মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংকটের পেছনে ইতিহাস

ইসরায়েল ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক ও সামরিক টানাপোড়েন দীর্ঘদিন ধরে চলছে। এর ফলে গোয়েন্দাদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

২০১৪ সালের গাজা যুদ্ধ থেকে শুরু করে, ইসরায়েলি গোয়েন্দারা বিভিন্ন ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী ও ইরানের প্রভাবশালী সংগঠনগুলোর তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তবে বিভিন্ন সময় বিশেষ করে ২০২৩ সালের বড় গোয়েন্দা ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এখন নতুন দিকনির্দেশনা তৈরি করা হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা প্রশিক্ষণে ভাষা ও সাংস্কৃতিক শিক্ষার গুরুত্ব

বিশ্বের বেশিরভাগ গোয়েন্দা সংস্থা আধুনিক গোয়েন্দা কাজে ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক দক্ষতার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের সিআইএ, যুক্তরাজ্যের এমআই৬, ও রাশিয়ার এসভিআর তাদের গোয়েন্দাদের জন্য ভাষা ও সাংস্কৃতিক প্রশিক্ষণকে প্রাধান্য দেয়।

ইসরায়েলের এই পদক্ষেপও আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা মানচিত্রে নিজেদের সক্ষমতা বাড়ানোর একটি উদ্যোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবন

আরবি ভাষা ও ইসলামিক স্টাডিজ শেখানোর মাধ্যমে ইসরায়েলি গোয়েন্দারা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনগুলোকে ভালোভাবে বুঝতে পারবে।

তবে নতুন প্রশিক্ষণ কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে কার্যকর করতে পর্যাপ্ত বাজেট, সময় ও উচ্চমানের প্রশিক্ষণ বিষয়ক উপকরণের প্রয়োজন হবে। পাশাপাশি গোয়েন্দাদের মানসিক প্রস্তুতিও অত্যন্ত জরুরি, যাতে তারা স্থানীয় সংস্কৃতির প্রতি সম্মান দেখিয়ে কার্যক্রম চালাতে পারে।

ইসরায়েলের সামরিক গোয়েন্দাদের জন্য আরবি ভাষা ও ইসলামি ধর্মের জ্ঞান বাধ্যতামূলক করার এই সিদ্ধান্ত মধ্যপ্রাচ্যের জটিল পরিস্থিতিতে গোয়েন্দাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

এটি শুধু ভাষাগত নয়, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে গোয়েন্দাদের মধ্যে গভীর পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণাত্মক দক্ষতা গড়ে তুলবে, যা ভবিষ্যতে ইসরায়েলের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে আরো শক্তিশালী করবে।

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button