ওয়াশিংটন থেকে প্রকাশিত এক খবর অনুযায়ী, ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি এমানুয়েল মাখোঁর ঘোষণা—আগামী সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পরিকল্পনা—যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওয়ের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে। তিনি মাখোঁর এই সিদ্ধান্তকে ‘বেপরোয়া’ এবং ‘মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে বাধা’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
রুবিও এক্স (সাবেক টুইটার) প্ল্যাটফর্মে প্রকাশিত পোস্টে বলেন, ফ্রান্সের এই পদক্ষেপ কেবলমাত্র ফিলিস্তিনের সশস্ত্র সংগঠন হামাসের প্রচারণাকে সাহায্য করবে এবং ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘর্ষের জটিলতা আরও বাড়াবে। তিনি উল্লেখ করেন, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার শিকার ইসরায়েলি জনগণের প্রতি এটি এক ধরনের অবিচার।
৭ অক্টোবর ২০২৩: সংঘাতের স্মৃতি ও বর্তমান প্রেক্ষাপট
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর, ফিলিস্তিনি সশস্ত্র সংগঠন হামাস একটি ব্যাপক সন্ত্রাসী হামলা চালায় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে, যা মধ্যপ্রাচ্যের নৈরাজ্যকে এক ধাপ সামনে নিয়ে যায়। এর জবাবে ইসরায়েল তার গাজা উপত্যকায় কঠোর ও নির্বিচার হামলা চালিয়ে গাজার অবকাঠামো ও বেসামরিক জনগণকে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত করে। এই সংঘাত এখনো থামেনি এবং আন্তর্জাতিকভাবে এর প্রভাব গভীরভাবে অনুভূত হচ্ছে।
ফরাসি প্রেসিডেন্ট মাখোঁ এই সংকটের মধ্যেই জাতিসংঘে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র স্বীকৃতির ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি আশা করেন, এই পদক্ষেপ গাজার পুনর্নির্মাণ এবং শান্তির পথ তৈরি করবে।
মাখোঁর বক্তব্য: শান্তি ও পুনর্গঠনের প্রতি গুরুত্ব
এমানুয়েল মাখোঁর পোস্ট অনুযায়ী, গাজায় যুদ্ধ বন্ধ করা ও সাধারণ মানুষের জীবন রক্ষা করা এখন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। ফরাসি নাগরিকরা মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তির জন্য অনুরোধ জানাচ্ছেন। তিনি বলেন, “হামাসকে নিরস্ত্র করতে হবে, গাজাকে সুরক্ষিত করতে হবে, গাজার পুনর্নির্মাণ নিশ্চিত করতে হবে।”
মাখোঁ আরও বলেন, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের মাধ্যমে শুধু রাজনৈতিক স্বীকৃতি নয়, তার টিকে থাকার জন্য নিরাপত্তার পরিবেশও নিশ্চিত করতে হবে। তিনি জাতিসংঘে এই প্রস্তাব পেশের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে ফিলিস্তিনের প্রতি ফ্রান্সের সমর্থন জানিয়েছেন।
মার্কো রুবিওর উদ্বেগ: শান্তি প্রক্রিয়ায় বাধা ও হামাসের প্রভাব
মার্কো রুবিওর মতে, ফ্রান্সের এই স্বীকৃতি মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করবে এবং হামাসকে শক্তি দেবে। তিনি বলেন, এটি ইসরায়েলি জনগণের প্রতি একটি দুঃখজনক অবিচার, যাঁরা গত বছর হামাসের হামলার শিকার হয়েছেন।
রুবিওর বক্তব্যে স্পষ্ট, তিনি মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সংঘাতের উত্সকে দমন এবং মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করতে হবে, রাজনৈতিক পদক্ষেপ নয় যা উত্তেজনা বাড়াবে।
ফিলিস্তিন রাষ্ট্র স্বীকৃতির আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট
ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া নিয়ে বিশ্ব রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে বিতর্ক রয়েছে। ইউরোপের অনেক দেশ ইতিমধ্যেই ফিলিস্তিনকে সীমিত বা পূর্ণ রাষ্ট্র স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েল সাধারণত এই ধরণের উদ্যোগকে সমর্থন করেনি।
ফ্রান্সের এই পদক্ষেপকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে কারণ এটি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে একটি শক্তিশালী বার্তা পাঠাতে চায়। এটি ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক অবস্থানকে দৃঢ় করার চেষ্টা হলেও মধ্যপ্রাচ্যের বিদ্যমান সংকটের জটিলতা বিবেচনা করে এর পরিণতি কী হতে পারে তা নিয়ে অনেকে সন্দিহান।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ
ফরাসি প্রেসিডেন্টের ঘোষণার পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা মত প্রকাশ করেছেন। অনেক দেশ শান্তিপ্রিয় সমাধানের জন্য ফিলিস্তিনের স্বীকৃতিকে ইতিবাচক বলে বিবেচনা করছেন, আবার কেউ কেউ মনে করছেন এটি উত্তেজনা বাড়িয়ে শুধু নতুন সংকট সৃষ্টি করবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র স্বীকৃতির পেছনে রাজনৈতিক প্রতীকী মূল্য থাকলেও এর বাস্তবায়ন সহজ হবে না। ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া এবং গাজার নিরাপত্তা পরিস্থিতি খুবই সংকটাপন্ন।
মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ও পুনর্গঠন: এক অপরিহার্য লক্ষ্য
গাজা উপত্যকায় চলমান যুদ্ধ ও সংকটের মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা এখন সবচেয়ে জরুরি। ফরাসি প্রেসিডেন্টের বার্তা অনুযায়ী, শুধুমাত্র রাষ্ট্র স্বীকৃতি নয়, গাজার অবকাঠামো পুনর্নির্মাণ এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই একমাত্র পথ।
এই অঞ্চলের দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতার জন্য হামাসের অস্ত্র ত্যাগ এবং রাজনৈতিক সমাধান সন্ধান করা অপরিহার্য। ফ্রান্সের উদ্যোগ আন্তর্জাতিক আলোচনার নতুন মাত্রা যোগ করেছে, যা ভবিষ্যতে শান্তির সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে।
ফ্রান্সের ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র স্বীকৃতি দেওয়ার পরিকল্পনা একটি সাহসী পদক্ষেপ হলেও তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিশালী দেশ থেকে বিরূপ প্রতিক্রিয়া এসেছে। মার্কো রুবিওর ‘বেপরোয়া সিদ্ধান্ত’ বলা মন্তব্য মধ্যপ্রাচ্যের নাজুক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে।
তবে মাখোঁর দাবি, এই পদক্ষেপ গাজার পুনর্গঠন ও শান্তির জন্য নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে। বিশ্ব সম্প্রদায়ের উচিত এখন গাজার যুদ্ধ বন্ধ করা, মানুষের জীবন রক্ষা করা এবং মধ্যপ্রাচ্যের স্থায়ী শান্তির জন্য কঠোর উদ্যোগ নেওয়া।
ফিলিস্তিনের রাষ্ট্র স্বীকৃতি নিয়ে চলমান এই বিতর্কের ভবিষ্যৎ বিশ্ব রাজনীতির ওপর গভীর প্রভাব ফেলবে—এবং এই অঞ্চলের লাখো মানুষের ভাগ্য নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।



