২০২৫ সালের জুলাই মাসে ব্রিটেনে ইসরায়েলের প্রতি অস্ত্র রপ্তানিতে সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞার আহ্বান জানিয়েছেন প্রায় ৬০ জন এমপি ও লর্ড, যারা হাউস অব কমন্স ও লর্ডস এর সদস্য। এক যৌথ চিঠিতে তারা ব্রিটিশ সরকারকে ইসরায়েলের সঙ্গে সামরিক সম্পর্ক বন্ধ করার দাবি জানিয়েছেন এবং অস্ত্র রপ্তানি লাইসেন্সের স্বচ্ছতা বাড়ানোর জন্যও চাপ দিয়েছেন।
এই চিঠি ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি ও বাণিজ্যমন্ত্রী জোনাথন রেনল্ডসকে ১৮ জুলাই পাঠানো হয়। এর আগে ল্যামি স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন যে, গাজায় যুদ্ধবিরতি না মানা হলে ইসরায়েলের ওপর আরও কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপের সম্ভাবনা রয়েছে।
ব্রিটেনসহ ২৭টি দেশের যৌথ প্রতিবাদ ও মানবিক সহায়তার আহ্বান
ব্রিটেনসহ অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ফ্রান্সসহ মোট ২৭টি দেশ ইসরায়েলের গাজায় চলমান যুদ্ধ ও ফিলিস্তিনিদের মানবিক অধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে নিন্দা জানিয়েছে। তারা ইসরায়েলের প্রতি জরুরি ভিত্তিতে গাজায় ত্রাণ সরবরাহে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে, যা ফিলিস্তিনিদের প্রতি এক বড় ধরনের মানবিক সহায়তা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
গতকাল ২২ জুলাই ব্রিটেনের জনপ্রিয় টিভি অনুষ্ঠান ‘গুড মর্নিং ব্রিটেন’ এ ডেভিড ল্যামি বলেন, “গত কয়েক মাসে আমরা একাধিক নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করেছি। যদি গাজায় ইসরায়েলের আচরণে কোন পরিবর্তন না আসে এবং মানুষের দুর্দশা কমানো না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে আরও কঠোর বিকল্প গ্রহণ করব।”
অস্ত্র রপ্তানিতে স্বচ্ছতার দাবিতে এমপি ও লর্ডদের উদ্বেগ
ব্রিটেনের এমপি ও লর্ডরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে, যদি ইসরায়েলে অস্ত্র রপ্তানি অব্যাহত থাকে তাহলে ব্রিটিশ সরকার ‘গণহত্যায় সহায়তাকারী’ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এই চিঠিতে জারাহ সুলতানা, জন ম্যাকডোনেল, জেরেমি করবিনসহ অনেক উচ্চপ্রতিষ্ঠিত এমপি ও লর্ডের স্বাক্ষর রয়েছে।
লেবার এমপি স্টিভ উইদারডেন বলেন, “গাজায় যেসব যুদ্ধবিমান ব্যবহৃত হচ্ছে, সেগুলোর ১৫ শতাংশ যন্ত্রাংশ ব্রিটেনে তৈরি। এটি ব্রিটিশ সরকারের রপ্তানি লাইসেন্স ছাড়া সম্ভব হত না।” তিনি আরো যোগ করেন, “এই বাস্তবতা এড়িয়ে যাওয়া যায় না এবং অস্ত্র রপ্তানির তথ্য সম্পর্কে সরকারের স্বচ্ছতা থাকা অত্যন্ত জরুরি।”
২০২৪ সালের অস্ত্র রপ্তানি ও সরকারের ব্যাখ্যা
২০২৪ সালে ব্রিটেন থেকে ইসরায়েলে অস্ত্র রপ্তানির তথ্য প্রকাশ করে এক্সপোর্ট কন্ট্রোল জয়েন্ট ইউনিট (ইসিজিইউ)। ১৪১.৬ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের ‘স্ট্যান্ডার্ড ইন্ডিভিজ্যুয়াল এক্সপোর্ট লাইসেন্স’ এর অর্ধেকের বেশি সরাসরি ইসরায়েলে ব্যবহারের জন্য ছিল বলে রিপোর্টে উল্লেখ থাকে।
তবে ট্রেডমন্ত্রী ডগলাস আলেকজান্ডার দাবি করেন, অধিকাংশ অস্ত্র সরবরাহ আসলে তৃতীয় দেশ বা ন্যাটো মিত্রদের কাছে যন্ত্রাংশ পুনঃরপ্তানির জন্য। তিনি বলেন, “প্রায় ৮৫ শতাংশ লাইসেন্স একটি নির্দিষ্ট ন্যাটো মিত্রের জন্য ইস্যু হয়েছে, যা ইসরায়েলি কোম্পানির সামরিক পণ্য রপ্তানির জন্য।”
চিঠির স্বাক্ষরকারীরা এই তথ্যের মধ্যে বিরোধ লক্ষ্য করে সরকারের কাছে বিস্তারিত ব্যাখ্যার দাবি জানিয়েছেন—যেমন প্রকল্পটির প্রকৃতি, সংশ্লিষ্ট ন্যাটো মিত্রের নাম, প্রকল্পের সময়কাল ও উদ্দেশ্য।
আদালতের রায় ও আইনি লড়াই
গত মাসে ব্রিটিশ হাইকোর্ট এক মামলায় রায় দেন, যেখানে মানবাধিকার সংগঠনগুলো ব্রিটেনের তৈরি এফ-৩৫ যুদ্ধবিমানের যন্ত্রাংশ ইসরায়েলে রপ্তানি বন্ধের দাবি জানিয়েছিল। এই যন্ত্রাংশ বিশ্বব্যাপী একটি যৌথ সরবরাহ ব্যবস্থার মাধ্যমে ইসরায়েলে পাঠানো হয়।
আদালত বলে, এই বিষয়টি আদালতের নয়; বরং নির্বাহী বিভাগের এখতিয়ারভুক্ত, যারা পার্লামেন্ট ও জনগণের কাছে জবাবদিহি করবে। এই আইনি লড়াই ২০ মাস ধরে চলে আসছে।
ইসরায়েলের গাজায় যুদ্ধবিমান ও ব্রিটেনের অংশীদারিত্ব
স্টিভ উইদারডেন স্পষ্ট করে বলেন, “গাজা মিশিয়ে দিতে যেসব যুদ্ধবিমান ব্যবহার হচ্ছে, সেগুলোর ১৫ শতাংশ যন্ত্রাংশ ব্রিটেনে তৈরি হয়। ব্রিটিশ সরকারের রপ্তানি লাইসেন্স ছাড়া এসব যুদ্ধবিমান কার্যকর হতে পারত না।”
এটি ব্রিটেনের সরকারের ওপর আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করেছে, যেন তারা গাজায় চলমান মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ততা থেকে বিরত থাকে।
গাজায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের আন্তর্জাতিক প্রতিবাদ
গত বছর গাজায় ইসরায়েলের মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে আইরিশ বিশ্ববিদ্যালয়ও তাদের ইসরায়েলের সঙ্গে একাডেমিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিভিন্ন অংশ থেকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিক্রিয়া আসছে।
বিশ্বব্যাপী শান্তি ও মানবাধিকার রক্ষায় ইসরায়েলের ওপর চাপ আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে, বিশেষ করে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার জন্য। ব্রিটেনসহ বিভিন্ন দেশের এমপি ও নেতারা এই চাপকে ব্যবহার করে সরকারকে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে বলছেন।
ভবিষ্যৎ পরিপ্রেক্ষিত
বিশ্বব্যাপী গাজায় মানবিক সংকট ও সংঘাতের স্থায়ী সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক চাপ বেড়েই চলেছে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের এই সিদ্ধান্ত এবং অস্ত্র রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞার আহ্বান ইসরায়েলের ওপর বৈশ্বিক চাপকে আরও দৃঢ় করবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
এছাড়া, ব্রিটেনের এই পদক্ষেপের মাধ্যমে অন্যান্য পশ্চিমা দেশও তাদের সামরিক ও কূটনৈতিক নীতি পুনর্বিবেচনা করবে বলে আশা করা হচ্ছে। মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নীতি গ্রহণ করার দাবিতে এই আন্দোলন বিশ্বজুড়ে শক্তিশালী হচ্ছে।
ব্রিটেনের প্রায় ৬০ জন এমপি ও লর্ডের অস্ত্র রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞার আহ্বান বিশ্ব রাজনীতিতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে নতুন এক মঞ্চ তৈরি করেছে। গাজার মানবিক সংকট ও আন্তর্জাতিক নিন্দার মাঝেও ব্রিটেনের রাজনৈতিক অঙ্গনে এ ধরনের স্বচ্ছতা ও নৈতিকতার দাবি বিশ্ববাসীর কাছে এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে।
সরকারের কাছে এখন সময় এসেছে তাদের সামরিক ও কূটনৈতিক নীতিতে নতুন করে ভাববার, যাতে মানবাধিকার ও শান্তির পথে অগ্রসর হওয়া যায়। এ উদ্যোগ বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার কর্মী ও শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের জন্য এক আশার দিশারি হয়ে উঠেছে।



