
ঢাকার উদ্দেশে যাত্রার সময় গাড়িতে উঠে জিম্মি হন যুবক শাহজাহান বাদশা। সাত ঘণ্টা ধরে তাকে আটকে রেখে দেশীয় অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে নগদ অর্থ ও এটিএম কার্ড ছিনিয়ে নেয় দুর্বৃত্তরা। একাধিক বুথ থেকে তোলা হয় সাড়ে ৬ লাখ টাকা।
ঘটনার বিস্তারিত
গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলায় এক ভয়াবহ ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করার সময় এক যুবককে প্রাইভেট কারে তুলে জিম্মি করে দুর্বৃত্তরা। এরপর টানা সাত ঘণ্টা ধরে তাকে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরিয়ে নগদ টাকা ও এটিএম কার্ডের মাধ্যমে ব্যাংকের বুথ থেকে উত্তোলন করে নেয় প্রায় ৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা।
ভুক্তভোগীর নাম শাহজাহান বাদশা (২৮)। তিনি শ্রীপুর উপজেলার মুলাইদ গ্রামের বাসিন্দা এবং ঢাকায় একটি পরীক্ষা দিতে যাচ্ছিলেন। এছাড়া পরীক্ষা শেষে বিদেশ যাত্রার প্রস্তুতিও ছিল তার।
শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে তিনি শ্রীপুরের মাওনা চৌরাস্তা এলাকায় গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিলেন। ঠিক সে সময় একটি প্রাইভেট কার যাত্রী তুলছিল। গাড়িতে আরও কয়েকজন যাত্রী দেখতে পেয়ে নিরাপদ মনে করে শাহজাহানও গাড়িতে ওঠেন। কিন্তু গাড়িতে ওঠার কিছুক্ষণ পরই বিপত্তি ঘটে।
কিভাবে দুর্বৃত্তরা পরিকল্পনা করে ছিনতাই করল
গাড়িতে উঠার কিছু সময় পর শাহজাহান লক্ষ্য করেন, গাড়িতে থাকা অন্য যাত্রীরা আসলে ছিনতাইকারী। চারজন দুর্বৃত্ত দেশীয় অস্ত্র দেখিয়ে তাকে জিম্মি করে। তার কাছ থেকে প্রায় ৫০ হাজার টাকা নগদ অর্থ ও স্মার্টফোন কেড়ে নেয়।
এরপর তারা তার সঙ্গে থাকা চারটি ব্যাংকের ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড ছিনিয়ে নেয় এবং ভয় দেখিয়ে কার্ডগুলোর পিন নম্বর জেনে নেয়। এরপর শুরু হয় একাধিক বুথ থেকে টাকা উত্তোলনের পালা।
দুর্বৃত্তরা তাকে নিয়ে বিভিন্ন ব্যাংকের এটিএম বুথে ঘোরে এবং পর্যায়ক্রমে চারটি ব্যাংকের কার্ড ব্যবহার করে মোট ৬ লাখ টাকা তুলে নেয়। একপর্যায়ে শাহজাহানকে মারধরও করা হয়।
কোথায় এবং কিভাবে ফেলে রেখে যায় দুর্বৃত্তরা
দীর্ঘ সাত ঘণ্টা জিম্মি করে রাখার পর রাত প্রায় ১টার দিকে দুর্বৃত্তরা তাকে গাজীপুরের ঢাকা–ময়মনসিংহ মহাসড়কের মেম্বারবাড়ি এলাকার ন্যাশনাল ফিড মিলের সামনে ফেলে রেখে চলে যায়।
পরে স্থানীয়দের সহায়তায় শাহজাহান তার পরিবারকে খবর দেন এবং ফেসবুকে নিজের অ্যাকাউন্টে লগইন করে একটি ভিডিও বার্তার মাধ্যমে পুরো ঘটনার বর্ণনা দেন।
ভিডিও বার্তায় তিনি জানান, “আমি গাড়িতে ওঠার পরপরই বুঝতে পারি, এটি সাধারণ যাত্রীর গাড়ি নয়। আমাকে অস্ত্র দেখিয়ে ভয় দেখানো হয়। আমার ব্যাংকের কার্ড ও পিন নম্বর দিয়ে তারা একে একে টাকা তুলে নেয়।”
থানায় অভিযোগ ও পুলিশের অবস্থান
শাহজাহান বাদশা ঘটনার বিষয়ে শ্রীপুর থানায় অভিযোগ করেছেন। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবদুল বারিক বলেন, “ঘটনাটি আমরা শুনেছি। যদিও ছিনতাইয়ের বেশির ভাগ অংশ জয়দেবপুর থানা এলাকার মধ্যে পড়েছে, তবুও যেহেতু তিনি শ্রীপুর থেকে যাত্রা শুরু করেছিলেন, তাই আমরা বিষয়টি গুরুত্বসহকারে তদন্ত করছি।”
পুলিশ জানায়, এটি একটি সুপরিকল্পিত ছিনতাইয়ের ঘটনা। অপরাধীরা পূর্ব থেকেই এই যাত্রাপথে টার্গেট করে সাধারণ যাত্রীদের গাড়িতে তুলে ছিনতাই চালিয়ে আসছিল।
ভুক্তভোগীর অভিমত ও মানসিক অবস্থা
শাহজাহান বাদশা জানান, তিনি এখনো মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। তিনি বলেন, “পরীক্ষা দিতে যাচ্ছিলাম, এরপর বিদেশ যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখন আমি সব কিছু ভুলে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।”
তিনি আরও বলেন, “আমি কারো সঙ্গে কোনো শত্রুতা করিনি। তাই বুঝতে পারছি না কেন আমাকে টার্গেট করা হলো। সবার প্রতি আমার অনুরোধ, অপরিচিত গাড়িতে ওঠার আগে ভালোভাবে যাচাই করুন।”
এর আগে এমন ঘটনা কি ঘটেছে?
সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন এলাকায় এমন বুদ্ধিমান ও প্রযুক্তিনির্ভর ছিনতাইকারীদের তৎপরতা বাড়ছে। অপরিচিত যাত্রাবাহী গাড়িতে সাধারণ যাত্রীদের তুলে ভয় দেখিয়ে এটিএম থেকে টাকা তোলার ঘটনা একাধিকবার ঘটেছে। তবে অনেক সময় এসব ঘটনার তদন্তে ধীরগতি ও অপরাধীদের শনাক্ত করতে ব্যর্থতা দেখা যায়।
গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা ও আশপাশের জেলায় এমন গাড়িভিত্তিক ছিনতাই চক্র নতুন করে সক্রিয় হয়েছে বলে ধারণা করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতামত
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মো. সালেহ উদ্দিন বলেন, “এটি অত্যন্ত চিন্তার বিষয় যে সাধারণ মানুষ রাতের বেলা গন্তব্যে যেতে গিয়ে এমন বিপদের মুখোমুখি হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচিত এ ধরনের অপরাধকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে দ্রুত অপরাধীদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা।”
তিনি আরও বলেন, “জনগণেরও সচেতনতা জরুরি। অপরিচিত প্রাইভেট কারে ওঠার আগে রেজিস্ট্রেশন নম্বর নোট করে রাখা এবং পরিবারের সঙ্গে তা শেয়ার করাও একান্ত প্রয়োজন।”
সারসংক্ষেপ
একজন সাধারণ যাত্রীকে এভাবে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে ঘুরিয়ে একাধিক বুথ থেকে টাকা তুলে নেওয়া নিঃসন্দেহে দেশের নিরাপত্তাব্যবস্থার ওপর বড় প্রশ্ন তুলে দেয়। যত দ্রুত সম্ভব এই ছিনতাইকারীদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার না করা হলে, সাধারণ মানুষদের মধ্যে ভয় ও অনিরাপত্তা আরও বাড়বে।
সচেতনতা, প্রযুক্তিগত সহায়তা ও দ্রুত তদন্ত — এই তিনটি দিকেই গুরুত্ব না দিলে এমন ঘটনা ভবিষ্যতে আরও বেড়ে যেতে পারে।
এম আর এম – ০৪৩০, Signalbd.com